১৩ বছরের চাকরি ছেড়ে উদ্যোক্তা হলেন সাইফুল ইসলাম পাঠান

সাইফুল ইসলাম পাঠান
সাইফুল ইসলাম পাঠান

১৩ বছরের কর্পোরেট ক্যারিয়ার ছেড়ে উদ্যোক্তা হওয়া সহজ নয়। চাকরির নিরাপত্তা, নির্দিষ্ট আয় এবং প্রতিষ্ঠিত ক্যারিয়ার ছেড়ে অনিশ্চিত পথে পা বাড়ানো অনেকের জন্যই কঠিন সিদ্ধান্ত। তবে কিছু মানুষ আছেন, যারা নিজের স্বপ্নের পেছনে দৌড়াতে ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত। সাইফুল ইসলাম পাঠান তাদেরই একজন। বুটেক্সের ৩২তম ব্যাচের এই সাবেক শিক্ষার্থী আজ একজন সফল উদ্যোক্তা। তবে তিনি শুধু নিজের জন্য স্বপ্ন দেখেননি, বরং তরুণদের জন্যও স্বপ্ন দেখাচ্ছেন—যাতে তারা চাকরির গণ্ডির বাইরে গিয়ে উদ্যোক্তা হওয়ার সাহস অর্জন করতে পারে।

সাইফুল ইসলাম পাঠানের শৈশব কেটেছে নরসিংদীর পলাশ থানায়। সেখানেই তার শিক্ষাজীবনের সূচনা। ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী ও প্রাণবন্ত। পড়াশোনার পাশাপাশি বিতর্ক, লেখালেখি এবং অন্যান্য সহশিক্ষা কার্যক্রমে ছিলেন সক্রিয়। তিনি দুবার বিটিভির জাতীয় বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন। পাশাপাশি তার লেখা ছোটগল্প ও কবিতা স্থানীয় পত্রিকায় প্রকাশিত হতো, যা নিয়ে তিনি গর্ব অনুভব করতেন।

প্রথমদিকে তার স্বপ্ন ছিল লেখক হওয়ার। তবে বাস্তবতা তাকে ভিন্ন পথে নিয়ে যায়। কলেজে পড়ার সময় তিনি উপলব্ধি করেন যে লেখালেখি দিয়ে আর্থিকভাবে সফল হওয়া বেশ কঠিন। তাই তিনি প্রকৌশলী হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

উচ্চমাধ্যমিকের পর তিনি একাধিক প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পান—বুয়েট, কুয়েট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। তবে তিনি বেছে নেন বুটেক্সকে, কারণ তার এলাকায় প্রচুর টেক্সটাইল কারখানা ছিল, যেখানে ভালো ক্যারিয়ার গড়ার সুযোগ ছিল। বড় ভাইদের পরামর্শ ও নিজের আগ্রহ থেকেই তিনি টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হন।

২০১১ সালে স্নাতক সম্পন্ন করার পর শুরু হয় তার কর্মজীবন। প্রথম চাকরি নেন থার্মেক্স গ্রুপে নিটিং প্রোডাকশন বিভাগে। তবে মাত্র ১৭ দিন পর চাকরি ছেড়ে দেন। এরপর ফকির নিটওয়্যারে ১১ মাস ডায়িং প্রোডাকশনে কাজ করেন। পরে মার্কেটিং সেক্টরে ছয় মাস চাকরি করার পর কেমিক্যাল বিজনেসে দেড় বছর কাজ করেন। তবে ব্যবসায় সুবিধা করতে না পেরে আবার চাকরিতে ফিরে আসেন।

প্রথম তিন বছর তার চাকরিজীবন সহজ ছিল না সাইফুলের। পরবর্তীতে ভিয়েলাটেক্স গ্রুপের গার্মেন্টস মার্চেন্ডাইজিং বিভাগে যোগ দেন তিনি। সেখানে কাজের অভিজ্ঞতা বাড়লেও সাইফুল ব্যাচমেটদের তুলনায় তিন বছর পিছিয়ে ছিলেন। তবে তিনি হাল ছাড়েননি। পরবর্তীতে বহুমুখী ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান রেনেসাঁ গ্রুপে যোগ দেন, যেখানে সাত বছর কাজ করার পর তিনি মার্চেন্ডাইজিং ম্যানেজার পদে উন্নীত হন।

এই দীর্ঘ চাকরিজীবনে তিনি গ্লোবাল কমিউনিকেশন, কর্পোরেট কালচার এবং বিজনেস স্ট্র্যাটেজি সম্পর্কে গভীরভাবে শিখেছেন। তবে ধীরে ধীরে তিনি উপলব্ধি করেন, চাকরির বেতন কাঠামো এবং পদোন্নতির সীমাবদ্ধতার কারণে তার আর্থিক অগ্রগতি প্রত্যাশিত হারে হচ্ছে না।

২০২০ সালে করোনা মহামারির সময় রেনেসাঁ গ্রুপ ওয়ার্ক ফ্রম হোমের ব্যবস্থা করলেও তিন মাসের বেতন কেটে নেয়। এতে তিনি হতাশ হন এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করেন। তিনি নিজের দক্ষতা ও শক্তির জায়গাগুলো খুঁজতে থাকেন এবং উপলব্ধি করেন যে, সেলস ও মার্কেটিং-এ তার বিশেষ দক্ষতা রয়েছে। এই খাতেই তার ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার সুযোগ বেশি।

২০২২ সালের আগস্টে, দীর্ঘ ১৩ বছরের চাকরিজীবনের ইতি টেনে তিনি উদ্যোক্তা হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

বর্তমানে তিনি ‘পাঠান এন্টারপ্রাইজ’ নামে একটি সেলস ও মার্কেটিংভিত্তিক কোম্পানি পরিচালনা করছেন, যা বিশ্বের ৫টির অধিক দেশ থেকে  ৭০টির অধিক স্পিনিং মিলের সুতা দেশে বিক্রয় করে থাকে। তার লক্ষ্য শুধু নিজের ব্যবসা বড় করা নয়, বরং একটি দক্ষ সেলস টিম তৈরি করা এবং যোগ্য সেলসম্যান গড়ে তোলা। তিনি চান, তার কোম্পানিতে বুটেক্সের জুনিয়রদের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করতে।

ভবিষ্যতে তিনি ল্যান্ড ডেভেলপমেন্ট, রিয়েল এস্টেট এবং ইন্ডাস্ট্রিয়াল সেক্টরেও ব্যবসা সম্প্রসারণের পরিকল্পনা করছেন।

সাইফুল ইসলাম পাঠানের মতে, একজন ব্যক্তি নিজেই একটি কোম্পানি। ব্যক্তি যেমন হবে, তার কোম্পানিও তেমন হবে। তিনি চান, বুটেক্সের শিক্ষার্থীরা শুধু চাকরির পেছনে না ছুটে উদ্যোক্তা হওয়ার কথা ভাবুক। তিনি নিজেকে সবসময় শিক্ষার মধ্যে রাখেন এবং চান, তার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও নতুন কিছু করুক, নিজেদের স্বপ্ন বাস্তবায়নে সাহসী হোক।

তার এই যাত্রা শুধুই একজন সফল উদ্যোক্তার গল্প নয়, এটি নতুন প্রজন্মের জন্য এক অনুপ্রেরণা। যারা চাকরির বাইরে নতুন কিছু করার কথা ভাবছেন, যারা নিজের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে চান, তাদের জন্য তিনি একটি জীবন্ত উদাহরণ।


সর্বশেষ সংবাদ