বিশ্ববিদ্যালয়ের ছুটি পেলেও বাড়ি ফেরার উচ্ছ্বাস নেই তাদের
- সুজন চন্দ্র দাস
- প্রকাশ: ২৭ মার্চ ২০২৫, ০৫:২৫ PM , আপডেট: ০৪ মে ২০২৫, ০২:৩৮ AM

বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে ছুটি মানেই কারো জন্য বাড়ি ফেরার আনন্দ, আবার কারো জন্য নিঃসঙ্গতা। হলে বা মেসে থাকা শিক্ষার্থীরা ছুটির আগে ব্যাগ গুছিয়ে, টিকিট কেটে বাড়ির পথে রওনা দেয়। অন্যদিকে, যাদের বাড়ি ক্যাম্পাসের কাছেই, তাদের কাছে ছুটি যেন নিছক আনুষ্ঠানিকতা।
নেই দূরযাত্রার রোমাঞ্চ, নেই বাড়ি ফেরার উচ্ছ্বাস। বরং কোলাহলমুখর ক্যাম্পাস মুহূর্তেই ফাঁকা হয়ে গেলে তৈরি হয় শূন্যতা। কর্মব্যস্ত পরিবেশ বদলে যায় নিস্তব্ধতায়। ছুটি তাই সবার জন্য এক রকম অনুভূতি বয়ে আনে না— কারো জন্য আনন্দ, কারো জন্য একাকিত্ব।
অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী জেবা সামিহা বলেন, "ছুটি" শব্দটা শুনতে ভালো লাগলেও বাস্তবে অনুভূতিটা ভিন্ন। যখন বন্ধুরা একে একে হল ছেড়ে বাড়ি ফিরতে শুরু করে, তখন ক্যাম্পাসটা কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগে। ব্যস্ততা হারিয়ে যায়, চেনা পরিবেশটা অচেনা মনে হয়। প্রথম দু’দিন ছুটিটা উপভোগ্য হলেও এরপর একাকিত্ব গ্রাস করতে শুরু করে। বন্ধুদের দারুণভাবে মিস করি। বিশ্ববিদ্যালয় বাড়ির কাছেই হওয়ায় মাঝে মাঝে ক্যাম্পাসে ঘুরতে যাই, কিন্তু তখন সবকিছু কেমন অচেনা লাগে। ক্লাস চলাকালীন কর্মব্যস্ত ক্যাম্পাস আর ছুটির সময়ে নিস্তব্ধ ক্যাম্পাস—এই বৈপরীত্য যেন আকাশ-পাতাল পার্থক্য তৈরি করে।”
অনেকের জন্য ছুটির আনন্দ মানে দীর্ঘদিন পর পরিবার-পরিজনের কাছে ফেরা। কিন্তু যাদের বাড়ি বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশে, তারা কি ছুটির প্রকৃত স্বাদ পান?
ফুড টেকনোলজি এন্ড নিউট্রিশনাল সায়েন্স বিভাগের শিক্ষার্থী সোহাগ বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের কাছাকাছি বাসা থাকার ফলে দীর্ঘ সময় পরে বাসায় ফেরার যে আনন্দ বা অনুভূতি, তা ঠিকভাবে উপভোগ করা যায় না। যারা দূরে থাকে, তারা নতুন পরিবেশে থাকার অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারে, নতুন জায়গায় ভ্রমণের সুযোগ পায় এবং অপরূপ প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারে। অন্যদিকে, বাসার কাছাকাছি থাকার ফলে পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গ সবসময় পাওয়া যায়, তবে এক জায়গাতেই সীমাবদ্ধ থাকতে হয়। দূরে থাকা শিক্ষার্থীরা তুলনামূলকভাবে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারে, সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্বাধীনতা অনুভব করে এবং ছুটিতে ট্রেন বা বাস ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিতে পারে। কিন্তু বাসার কাছে থাকলে এসব সুযোগ অনেক ক্ষেত্রেই সীমিত হয়ে যায়। পাশাপাশি, পরিবারের কাছে থাকার কারণে কিছু পারিবারিক দায়িত্ব পালন করতে হয়, যা দূরে থাকা শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে কম থাকে। সব মিলিয়ে, যাদের বাড়ি ক্যাম্পাসের কাছে, তাদের অভিধানে ‘ছুটি’ শব্দটি থাকলেও তার প্রকৃত অনুভূতি যেন আর থাকে না।”
হিসাববিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী মির্জা তারেক বলেন, "আমার বাড়ি টাঙ্গাইল শহরেই, তাই ঈদে বাড়ি ফেরার সেই বিশেষ উচ্ছ্বাস আমি কখনো অনুভব করি না। জানালার ধারে বসে দেখি, চারপাশে ঈদের ব্যস্ততা— বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থাকা বন্ধুরা সবাই বাড়ির পথে, কেউ ট্রেনে, কেউ বাসে, কেউ বাইকে। তাদের চোখে একরকম আনন্দ— মা-বাবার কাছে ফেরা, শৈশবের স্মৃতিতে ফিরে যাওয়া।
কিন্তু আমি? আমার তো কোথাও যাওয়ার প্রয়োজন নেই, অথচ মনে হয় দরকার ছিল!
রাতে মা বললেন, ‘তোর বন্ধুরা সবাই বাড়ি গেছে, তুই তো পাশেই থাকিস, তোর জন্য অপেক্ষা করতে হয় না।’ কথাটা স্বাভাবিক, কিন্তু আমার মনে অদ্ভুত শূন্যতা কাজ করল।”
তিনি আরো বলেন, “শহরের রাস্তা ফাঁকা, চায়ের দোকানগুলো বন্ধ, পরিচিত মুখগুলো নেই— যেন চারপাশ থেকে কিছু হারিয়ে গেছে। আমি কোথাও ফেরার জন্য প্রস্তুত নই, আবার কোথাও থাকার জন্যও নই। মানুষ ঈদে বাড়ি ফেরে, কিন্তু আমি কোথায় ফিরব? আমার বাড়ি তো এখানেই!”
অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী স্মৃতি ইসলাম বলেন, “আমার বাসা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশেই। প্রতিদিন বাড়ি থেকেই ক্লাসে আসা-যাওয়া করি। কিন্তু আমার অনেক বন্ধু রয়েছে, যাদের বাড়ি অনেক দূরে। দেখা যায়, তারা মাসের পর মাস বাড়ি যেতে পারে না। ছুটির আগে তাদের অনেক ব্যস্ততা থাকে— কেউ আগে থেকেই টিকিট কাটে, কেউ বাড়ির জন্য শপিং করে, কেউ আবার টিউশন শেষ করে হল বা মেস ছাড়ার প্রস্তুতি নেয়। তারপর যখন তারা বাড়ি ফেরে, তখন তাদের আবেগঘন পোস্ট দেখি— মায়ের হাতের রান্না খাওয়া, পরিবারকে জড়িয়ে ধরার আনন্দ। এসব দেখে কখনো কখনো মনে হয়, আমি কি কোনো বিশেষ অনুভূতি থেকে বঞ্চিত?”
স্মৃতি বলেন, “বন্ধুরা বলে, যাদের বাড়ি বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছেই, তারা আসলে অনেক ভাগ্যবান। কারণ, বাড়ির থেকে দূরে থাকার কষ্ট খুব সুখকর নয়। দূরে থাকা মানে পরিবারকে মিস করা, বাড়ির খাবারের জন্য মন খারাপ করা, নিজের কাজ নিজেকেই সামলানো। কিন্তু আমাদের তো এসব চিন্তা করতে হয় না। তাই হয়ত আমাদের আফসোস থাকলেও, ওদের অভিজ্ঞতা এত সহজ নয়।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছুটি সবার জন্য এক নয়। দূরে থাকা শিক্ষার্থীদের জন্য এটি আনন্দের, পরিবারের কাছে ফেরার সুযোগ। কিন্তু যাদের বাড়ি ক্যাম্পাসের কাছাকাছি, তাদের জন্য ছুটি কখনো কখনো শূন্যতা বয়ে আনে। কর্মব্যস্ত ক্যাম্পাসের নিস্তব্ধতা, পরিচিত মুখের অনুপস্থিতি—সব মিলিয়ে ছুটির অনুভূতি একেকজনের জন্য একেক রকম।