রেজিস্ট্রার পদ নিয়ে হট্টগোল, সেদিন যা ঘটেছিল ইবি উপাচার্যের কার্যালয়ে

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (ইবি)
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (ইবি)

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) রেজিস্ট্রার সহ প্রশাসনের বিভিন্ন পদে থাকা আওয়ামী দোসরদের অপসারণের দাবিতে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল উপাচার্যের কার্যালয়। কর্মকর্তা কর্মচারী, প্রক্টর-প্রো-ভিসি এবং ছাত্রদল ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দফায় দফায় হট্টগোলে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে প্রশাসনিক ভবনের পরিবেশ। গত মঙ্গলবার বেলা ১২টার পর থেকে দুপুর পর্যন্ত এসব ঘটনা ঘটে। ঘটনার পরেরদিন বিকেলে রেজিস্ট্রার পদে ইলেক্ট্রিক্যাল এন্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মনজুরুল হককে নিয়োগ দেন উপাচার্য ড. নকীব নসরুল্লাহ। আওয়ামী সুবিধাভোগীদের অপসারণ করতে যেয়ে ভিসি অফিসে কেন এই লজ্জাজনক ঘটনার সূত্রপাত সেই প্রশ্ন এখন জনমনে। 

জানা যায়, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের রেজিস্ট্রার, পরিকল্পনা দপ্তরসহ বিভিন্ন পদে আওয়ামী সুবিধাবাদীদের অপসারণ এবং গণঅভ্যুত্থানের পক্ষের ব্যক্তিদের নিয়োগ দিতে বিভিন্ন সময় দাবি জানিয়ে আসছিলো ছাত্রদল, ছাত্রশিবির, ছাত্র ইউনিয়ন, ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এরই ধারাবাহিকতায় গত ৩ মার্চ উপাচার্যের সাথে মতবিনিময়কালে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন রেজিস্ট্রার হিসেবে একজন শিক্ষককে নিয়োগের দাবি জানায়। গতকাল সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ে চলমান মেগা প্রকল্পের বিষয়ে পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিভাগের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক ড. নওয়াব আলীর সাথে প্রশাসনের এক মিটিং চলাকালে ভিসি অফিসে জমায়েত হয়ে নওয়াব আলীকে বের করে দেওয়ার দাবীতে হট্টগোল করে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএনপি ও জামায়াতপন্থী কর্মকর্তা কর্মচারীরা। 

পরবর্তীতে প্রক্টরিয়াল বডি ও প্রশাসনের সহযোগিতায় নওয়াব আলীকে উপাচার্যের কার্যালয় থেকে বের করে নিয়ে যাওয়া হয়। এসময় শাখা ছাত্রদলের আহবায়ক সাহেদ আহম্মেদ ও সদস্য সচিব মাসুদ রুমি মিথুনের নেতৃত্বে ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা উপাচার্যের কার্যালয়ে প্রবেশ করে। এসময় সেখানে আগে থেকে উপস্থিত ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. এম এয়াকুব আলী, ট্রেজারার অধ্যাপক ড. জাহাঙ্গীর আলম, প্রক্টর অধ্যাপক ড. শাহীনুজ্জামান, সহকারী প্রক্টর অধ্যাপক ড. আব্দুল বারী ও অধ্যাপক ড. ফকরুল ইসলাম, জিয়া পরিষদের সভাপতি অধ্যাপক  ড. ফারুকুজ্জামান খান, সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম। ছাত্রদলের নেতারা ভিসির কার্যালয়ে প্রবেশ করে কক্ষে অবস্থানরত সাংবাদিকদের সেখান থেকে বেরিয়ে যেতে বলেন। এর কিছুক্ষণ আগেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক পরিষদের নেতৃবৃন্দ সেখান থেকে বেরিয়ে পার্শ্ববর্তী আমতলায় অবস্থান নেন। 

বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, রেজিস্ট্রার পদে নিয়োগকে কেন্দ্র করে বাকবিতন্ডায় জড়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসি ও প্রক্টর। ছাত্রদলের আহবায়ক সাহেদ আহম্মেদের নেতৃত্বাধীন গ্রুপ রেজিস্ট্রার পদে কর্মকর্তা ওয়ালিদ হাসান পিকুলের নাম প্রস্তাব করলে প্রক্টর তাদের কাছে আরো কয়েকজনের নাম প্রস্তাবনা চান। এই নিয়ে প্রক্টর ও প্রো ভিসি তর্কে জড়ান। এসময় উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. এম এয়াকুব আলী প্রক্টর অধ্যাপক ড. শাহীনুজ্জামানকে ‘জামায়াত’ বলে আখ্যা দিলে দুজনের মধ্যে উচ্চবাচ্য সৃষ্টি হয়। এসময় কক্ষের বাইরে অবস্থানরত সাংবাদিকরা উপাচার্যের কার্যালয়ে ঢুকতে চাইলেও ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা বাধা দেয়। ভিসি অফিসের হট্টগোলের শব্দ পার্শ্ববর্তী আমতলা পর্যন্ত পৌঁছালে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক এস এম সুইট, সহ সমন্বয়ক নাহিদ হাসান, ইসমাইল হোসেন রাহাত, ইয়াশিরুল কবীর সৌরভ, সায়েম আহমেদ, তানভীর মন্ডল এবং অন্যান্যরা আবারো দৌড়ে উপাচার্যের কার্যালয়ে প্রবেশ করলে চাইলে ছাত্রদল তাদেরও বাধা দেয়। বাধা উপেক্ষা করে বৈষম্যবিরোধীরা কার্যালয়ে প্রবেশ করলে তুমুল হট্টগোলের সৃষ্টি হয়। এসময় কার্যালয়ের ভেতরে ভিসি, প্রো-ভিসি, ট্রেজারার, প্রক্টর এবং ছাত্র নেতারাও উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় করে। এছাড়াও প্রো-ভিসির সাথে প্রক্টর ড. শাহীনুজ্জামান ও সহকারী প্রক্টর অধ্যাপক ড. ফকরুল ইসলামের উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হয়।

এসময় বৈষম্যবিরোধী নেতৃবৃন্দ ভিসির উদ্দেশ্যে বলেন, আপনি যখন আপনার প্রশাসনের সাথে কথা বলবেন তখন বাইরের কেও কেন এখানে থাকবে। গতকাল আপনাকে বলেছিলাম যে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ছাড়া কারো সাথে আপনি নেগোসিয়েশনে যাবেন না, কারো কথা আপনি শুনবেন না। আজকে এই রুমের আওয়াজ আমতলা থেকে শোনা যাচ্ছে। আজকের এই ঘটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য লজ্জাজনক। এসময় সমন্বয়ক এস এম সুইট বলেন, এই দুঃসাহস কার আছে, যে যে কর্মকর্তারা আজকে চিল্লাচিল্লি করছে, আমি তাদের সবগুলোর অবস্থান জানি। এই কুষ্টিয়া এবং ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি একা হাতে আন্দোলন পরিচালনা করছি। আমরা প্রশাসনের সবাইকে সহযোগিতা করে আসছি। কেউ যদি আমাদের এই সহযোগিতাকে দূর্বলতা মনে করে তার গলার নালি আমি টেনে ছিঁড়ে ফেলব। এছাড়াও তিনি  হট্টগোলের ঘটনায় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ভিসিকে ৪৮ ঘন্টার আল্টিমেটাম দেন। পাশাপাশি এর আগে ঘটা ক্যাম্পাসে দুই তিনটি ঘটনা এবং প্রক্টরের গায়ে হাত তোলার বিষয়েরও আপডেট চান এ ইবি সমন্বয়ক। 

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী শাখা ছাত্রদলের সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আনোয়ার পারভেজ বলেন, দীর্ঘদিন ধরে রেজিস্ট্রার পদে বিএনপিপন্থী একজন কর্মকর্তা নিয়োগের দাবি জানিয়ে আসছিলো ছাত্রদলের আহ্বায়ক সাহেদ আহম্মেদ ও সদস্য সচিব মাসুদ রুমি মিথুন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর তাদের রেজিস্ট্রার পদে একজন কর্মকর্তার নাম প্রস্তাব না করে আরো কয়েকজনের নাম প্রস্তাব করার কথা বলেন। প্রক্টর এ কথা কেন বললো এই জন্য ছাত্রদলের প্যাডে প্রক্টরের পদত্যাগ দাবি করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে আহ্বায়ক ও সদস্য সচিব। কিন্তু আমি এই সিদ্ধান্তে অসম্মতি জানিয়ে তাদের ছাত্রদলের প্যাড ব্যবহার করতে নিষেধ করি। এরপর তারা ভিসির সাথে কথা বলতে যায়। এসময় আহবায়ক প্রক্টরের বিষয়ে কথা উঠায়। তখন প্রো-ভিসি প্রক্টরকে জামায়াত বলে সম্বোধন করলে হট্টগোল তৈরি হয়। কোন একক ব্যক্তির দায় ছাত্রদল নিবে না।

পরবর্তীতে জানতে চাইলে প্রক্টর অধ্যাপক ড. শাহীনুজ্জামান বলেন, ‘আমাকে জামায়াত বলে সম্বোধনের বিষয়টি কোনোভাবেই মেনে নেওয়ার নয়। বিগত দিনে আমি কী করেছি তা সবাই জানেন।’ এই বিষয়ে কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি। এছাড়া শাখা ছাত্রদলের আহবায়ক সাহেদ আহম্মেদকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি। 

পরবর্তীতে উপাচার্য ড. নকীব নসরুল্লাহ বলেন, এই রুমে এরকম চিৎকার চেঁচামেচি ইতিহাসে কোনদিন হয়তো হয় নাই। প্রশাসনের ৩ জন আমরা সবসময়ই বলেছি যে আমরা চুপ থেকে সবার কথা শুনে কাজ করি। আমি আজকে সবাইকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেছি। একটি কাজও নেই যা আমি প্রো-ভিসি বা ট্রেজারারকে না জানিয়ে করেছি৷ এই পদগুলো পরিবর্তনের কোন সিদ্ধান্ত এখনো পর্যন্ত আসেনি তবে বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রস্তাবনা এসেছে। আমরা সিন্ডিকেট করেছি তার সিদ্ধান্তটা আজকে মাত্র আমার সই হয়েছে। রেজিস্ট্রার ইতোমধ্যে ছুটিতে আছে, এই মাসের পর সে থাকবে না, ৪ টি পদেই আমরা পরিবর্তন আনবো। 

জানতে চাইলে প্রো-ভিসি অধ্যাপক ড. এম এয়াকুব আলী বলেন, আমি কর্মচারীদের দ্বারা বেষ্টিত থাকায় ভিসি অফিসে যেতে একটু দেরি হয়ে যায়। ছাত্রদলের আহবায়ককে কোন এক শিক্ষক নাকি রেজিস্ট্রারের বিকল্প কয়েকটি নাম বলতে বলেছে। আমি সাহেদকে  এসম্পর্কে সত্যটা কি জিগ্যেস করলে ইসলামের ইতিহাসের শিক্ষক আব্দুল বারী আমাকে 'চুপ' বলে আমার দিকে তেড়ে আসে। এব্যাপারে ভিসির কোন ভুমিকা আমি দেখিনি উল্টো সে আমাকে নিবৃত্ত করতে চায়। আব্দুল বারীর কাছে ভিসি কোন দিক দিয়ে 'ধরা' আছেন কিনা আমি জানিনা। 

বিভিন্ন রাজনৈতিক গোষ্ঠী, ইসলামিক গোষ্ঠী অনৈতিকভাবে বেশ কিছু জিনিস ভিসিকে দিয়ে আদায় করতে চায় অভিযোগ করে প্রো-ভিসি বলেন, আমি সেখানে আইনের কথা বলে বাধা দেই বিধায় আমার উপর ক্ষিপ্ত তারা। আমি সততার সাথে চলব, মেধার মূল্যায়ন করবো এবং সত্যের পূজা করবো। কিন্তু এখানে দলবাজি শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে বড় বড় দলের প্রভাব দেখিয়ে অনৈতিকভাবে বিভিন্ন জিনিস আদায় করা হয়েছে। এমন অনেক হয়েছে যে মাননীয় ভাইস চ্যান্সেলর তাদের কথা মোতাবেক অনেক ফাইল অনুমোদন দিয়েছে যেটা পরে আমি আইন দেখিয়ে বাতিল করিয়েছি। আমি অন্যায় অবিচার মানবো না। কোন শক্তিশালী রাজনৈতিক দল যদি আমাকে হুমকি দেয় সে হুমকির কাছে আমি নত হব না এবং কোন কট্টরপন্থীদের হাতে আমি বিশ্ববিদ্যালয় তুলে দেব না। 


সর্বশেষ সংবাদ