সীমাবদ্ধতার মধ্যেও রোগীর সর্বোচ্চ সেবার চেষ্টা ক্যান্সার হাসপাতালে

জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল
জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল

হাসপাতালের করিডোরজুড়ে ব্যস্ততা। রোগীর আনাগোনা, স্বজনদের উদ্বেগ, চিকিৎসক-নার্সদের তৎপরতায় চারপাশ গমগম করছে। এর মাঝেই এক বৃদ্ধ দম্পতি এদিক-সেদিক ঘুরছেন। তাদের ক্লান্ত মুখ, ভারী চোখ, আর নিঃশব্দ দীর্ঘশ্বাস যেন বলে দিচ্ছে—তারা একা, ভীষণ একা। মঙ্গলবার (১১ মার্চ) জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে গিয়ে পাওয়া গেল এমন চিত্র। 

কিশোরগঞ্জ থেকে আসা মোসা. স্বপ্নেহার (৫৫) এক বছর ধরে ক্যান্সারে ভুগছেন। প্রতিদিনের শারীরিক যন্ত্রণা আর মানসিক অবসাদ তাকে ক্লান্ত করে তুলেছে। তিনি চিকিৎসার আশায় স্বামীকে সঙ্গে নিয়ে এ হাসপাতালে এসেছেন। কিন্তু সঙ্গে নেই কোনো সন্তান, নেই কোনো আত্মীয়-স্বজন। যেন জীবনের শেষ লড়াইয়ে একা দাঁড়িয়ে আছেন তারা।

স্বপ্নেহারের কণ্ঠে হতাশার সুর, ‘ডাক্তার পরীক্ষা করে কিছু টেস্টের নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু সেসব পরীক্ষা করাতে অনেক টাকা লাগছে। আমরা গরিব মানুষ, এত টাকা কোথায় পাব? তবু বাঁচার আশা নিয়েই এসেছি।’

হাসপাতালটিতে ৩০০ জন চিকিৎসক, ১০০ জন মেডিকেল শিক্ষার্থীসহ ৫০০ জন নার্স এবং প্রায় ২০০ জন স্টাফ কর্মরত রয়েছেন। তারা সবাই ক্যান্সার চিকিৎসা ও গবেষণায় নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। এটি দেশের একমাত্র বৃহৎ ক্যান্সার হাসপাতাল হলেও ১৮ কোটি মানুষের তুলনায় এটির সক্ষমতা অত্যন্ত সীমিত।

হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু এখনো বেড মেলেনি। করিডোরের এক কোনায় তারা দাঁড়িয়ে আছেন আর অজানা অনিশ্চয়তার মাঝে অপেক্ষা করছেন। কখন বেড মিলবে? চিকিৎসা কতদিন চলবে? সুস্থ হতে পারবেন তো? তাদের এসব প্রশ্নের উত্তর যেন কারও কাছে নেই।

স্বপ্নেহারের স্বামীও নীরব। তার চোখে অসহায়ত্বের ছাপ স্পষ্ট, কিন্তু মুখে কোনো অভিযোগ নেই। হয়তো তিনিও জানেন, কিছু বললে লাভ নেই। হাসপাতালের নিয়ম অনুযায়ী যা হওয়ার, তাই হবে। তবু স্ত্রীর হাত ধরে রয়েছেন, যেন এই কঠিন সময়ে এটুকুই তার শেষ সম্বল।

চারপাশের কোলাহল, ডাক্তারদের ডাক, অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন—সব মিলিয়ে আশপাশ তুমুল ব্যস্ত। কিন্তু তাদের পৃথিবী থমকে আছে একটাই প্রশ্নে—তারা কি একটু চিকিৎসা পাবেন? একটু আশার আলো কি জ্বলবে?

সুমন (৩২) রংপুর থেকে তার ক্যান্সার আক্রান্ত বাবাকে নিয়ে হাসপাতালে এসেছেন। বাবাকে নিয়ে গত দুই দিন ধরে তিনি হাসপাতালে অবস্থান করছেন। কিন্তু এখনো কোনো বেড পাননি, যার ফলে মেঝেতেই থাকতে হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘আমরা এখনো বেডের জন্য আবেদন করিনি। তবে চিকিৎসার প্রয়োজনীয়তা বিবেচনা করে যত দ্রুত সম্ভব একটি বেড পেতে চাই।’

সুমন বলেন, ‘এক মাস আগে জানতে পারি, আমার বাবা ক্যান্সারে আক্রান্ত। এ রোগ শনাক্ত করতে এবং সঠিক চিকিৎসার পরিকল্পনা করতে অনেকগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন হয়েছে, যা বেশ ব্যয়বহুল। চিকিৎসার জন্য প্রচুর টাকার প্রয়োজন হচ্ছে, আমাদের মতো সাধারণ মানুষের জন্য যা অনেক কঠিন। তবুও বাবার সুস্থতার জন্য আমরা সব ধরনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’

‘এই হাসপাতাল দেশে ক্যান্সার চিকিৎসার অন্যতম প্রধান কেন্দ্র। তাই এখান থেকে সর্বোত্তম চিকিৎসা পাবো বলে আশা করছি। ডাক্তারদের সাড়া ও আন্তরিকতা এখন পর্যন্ত যথেষ্ট ভালো লাগছে’, তিনি যোগ করেন। 

হাসপাতালের চিকিৎসা সেবা নিয়ে জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. জাহাঙ্গির বলেন, বর্তমানে হাসপাতালটিতে ৩০০ জন চিকিৎসক, ১০০ জন মেডিকেল শিক্ষার্থীসহ ৫০০ জন নার্স এবং প্রায় ২০০ জন স্টাফ কর্মরত রয়েছেন। তারা সবাই ক্যান্সার চিকিৎসা ও গবেষণায় নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। এটি দেশের একমাত্র বৃহৎ ক্যান্সার হাসপাতাল হলেও ১৮ কোটি মানুষের তুলনায় এটির সক্ষমতা অত্যন্ত সীমিত।

আরও পড়ুন: আওয়ামী লীগ নেতার নেতৃত্বে গুলি করে সমন্বয়কের বাবাকে হত্যা

তিনি বলেন, ‘আমরা সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা দিয়ে রোগীর সেবা দেওয়ার চেষ্টা করছি। তবে হাসপাতালটিতে আধুনিক চিকিৎসা সরঞ্জাম ও লজিস্টিক সাপোর্টের অভাব রয়েছে। তাছাড়া দালাল চক্রের সমস্যাও আমাদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। আমরা হাসপাতালটিকে দালালমুক্ত করতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করছি, যাতে রোগীরা হয়রানি ছাড়া সর্বোত্তম সেবা পেতে পারেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের হাসপাতালে ডিমান্ড বেশি কিন্তু ক্যাপাসিটি কম। তবে ভবিষ্যতে দেশে আটটি নতুন ক্যান্সার হাসপাতাল চালু হবে। এটি আমাদের জন্য আশার আলো হয়ে উঠবে। অন্যদিকে লজিস্টিক সাপোর্টের অভাব রয়েছে এবং মেশিনারি ঘাটতির কারণে কিছু সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে।’

এখান থেকে নিয়মিত জার্নাল প্রকাশিত হয় জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের জার্নালের নাম ক্যান্সার জার্নাল অব বাংলাদেশ। বর্তমানে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আমাদের কোন চুক্তি নেই। তবে আমরা আন্তর্জাতিক সেমিনার, সেম্পোজিয়াম ও ওয়ার্কশপ আয়োজন করে থাকি। যেখানে বিদেশি স্পিকাররা উপস্থিত থেকে তাদের ক্যান্সার নিয়ে মতামত ও গবেষণার গুরুত্বপূর্ণ তথ্য শেয়ার করেন। এসব কর্মকাণ্ড আমাদের মেডিকেল সেবার মান বৃদ্ধি করছে।’


সর্বশেষ সংবাদ