পারমাণবিক অস্ত্রে এগিয়ে পাকিস্তান, সেনা-নৌ-বিমান বাহিনীতে কার কত অস্ত্র?

ফের উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে দক্ষিণ এশিয়ার দুই পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্র—ভারত ও পাকিস্তান। রাতের আঁধারে একে অপরের সীমান্তে পাল্টাপাল্টি হামলা চালিয়েছে দেশ দু’টি। এতে এখন পর্যন্ত পাকিস্তানে আটজন এবং ভারতে সাতজন নিহত হয়েছেন বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। মঙ্গলবার (৫ মে) দিবাগত মধ্যরাতে পাকিস্তান শাসিত কাশ্মীর ও দেশটির মূল ভূখণ্ডের অন্তত নয়টি স্থানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় ভারত।
পাক-ভারত যুদ্ধে প্রশ্ন উঠেছে দুই দেশের সামর্থ্য নিয়ে। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ হওয়ার পর একাধিকবার যুদ্ধেও জড়িয়েছে ভারত-পাকিস্তান। ফলে ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে উভয় দেশ উল্লেখ করার মতো সামরিক শক্তিও বজায় রেখে চলেছে।
দুই দেশের মধ্যে যখনই সংঘাত-উত্তেজনা সৃষ্টি হয়, তখন সামরিকভাবেও উভয়ের সামরিক সক্ষমতার বিষয়টি আলোচনায় উঠে আসে। এই সক্ষমতার গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো নিয়ে বিশ্লেষণমূলক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে মালয়েশিয়াভিত্তিক ‘ডিফেন্স সিকিউরিটি এশিয়া’।
গত ২৫ এপ্রিল ডিফেন্স সিকিউরিটি এশিয়া তাদের ওয়েবসাইটে ‘গ্লোবাল ফায়ারপাওয়ার সূচক (জিএফপি) ২০২৫’ প্রকাশ করে। এতে বলা হয়েছে, সামগ্রিক র্যাঙ্কিংয়ে ভারত বিশ্বের মধ্যে চতুর্থ এবং পাকিস্তান বিশ্বে ১২তম।
সামরিক-বেসামরিক জনশক্তি
জনসংখ্যার দিক দিকে ভারত বিশ্বের দ্বিতীয়। দেশটিতে ১৪০ কোটি মানুষের বসবাস। সক্রিয় সেনা ১৪ লাখ ৬০ হাজার (বিশ্বে দ্বিতীয়)। রিজার্ভ সেনা ১১ লাখ ৬০ হাজার (বিশ্বে সপ্তম)। আধা সামরিক বাহিনীর সদস্য ২৫ লাখ ৩০ হাজার (বিশ্বে দ্বিতীয়)। মোট সামরিক (সক্রিয় ও রিজার্ভ সেনা এবং আধা সামরিক বাহিনী) জনবল ৫১ লাখ।
বিমানবাহিনী
ভারতের মোট বিমান ২ হাজার ২২৯টি। এর মধ্যে যুদ্ধবিমান ৫১৩ থেকে ৬০৬টি। আধুনিক বিমানের মধ্যে রয়েছে এসইউ–৩০এমকেআই, রাফায়েল, তেজস। তাদের রয়েছে আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা এস-৪০০। হেলিকপ্টার আছে অ্যাপাচি ও চিনুক। আরও আছে চারটি ‘এয়ারবর্ন আর্লি ওয়ার্নিং অ্যান্ড কন্ট্রোল (এইডব্লিউঅ্যান্ডসি)’ ব্যবস্থা।
অন্যদিকে পাকিস্তানের মোট বিমান ১ হাজার ৩৯৯ থেকে ১ হাজার ৪৩৪টি। এর মধ্যে যুদ্ধবিমান ৩২৮ থেকে ৩৮৭টি। আধুনিক বিমানের মধ্যে রয়েছে এফ-১৬ ফাইটিং ফ্যালকন, জেএফ-১৭ থান্ডার, মিরেজ থ্রি/ফাইভ। আছে ভারতের চেয়ে বেশি যুদ্ধে ব্যবহার উপযোগী হেলিকপ্টার (এএইচ-১এফ কোবরাসহ)। এইডব্লিউঅ্যান্ডসি আছে সাতটি, যা ভারতের চেয়ে বেশি।
নৌবাহিনী
ভারতের জাহাজ রয়েছে ২৯৪টি। বিমানবাহী রণতরি আছে ২টি। সাবমেরিন ১৮টি (পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিন আইএনএস আরিহান্টসহ)। ডেস্ট্রয়ার ১৩টি। ফ্রিগেট ১৪টি। প্যাট্রোল নৌযান ১০৬টি। যুদ্ধে ব্যবহারের উপযোগী বিমান ৭৫টি (নৌবাহিনীর)। নৌবাহিনী সদস্যসংখ্যা ৬৭ হাজার ৭০০।
পাকিস্তানের জাহাজ ১২১টি। সাবমেরিন ৮টি। ফ্রিগেট ৯টি। প্যাট্রোল নৌযান ১৭টি। এ বাহিনীর যুদ্ধবিমান ৮টি। নৌবাহিনী সদস্যসংখ্যা ২৩ হাজার ৮০০।
প্রতিরক্ষা বাজেট
২০২৫-২৬ অর্থবছরে ভারতের বাজেট ৭ হাজার ৯০০ কোটি ডলার। যা জিডিপির ২ দশমিক ১ শতাংশ। এ ব্যয় পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় ৯ দশমিক ৫ শতাংশ বেশি।
পাকিস্তানের বাজেট ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ কোটি ডলার (অর্থনৈতিক সংকটের কারণে শীর্ষ দেশের তালিকায় নেই)। এই ব্যয় জিডিপির ৩ দশমিক ৬ শতাংশ।
ভারতের প্রতিরক্ষা বাজেট পাকিস্তানের ৬ থেকে ৮ গুণ। তবে বাজেট-সংকটে পাকিস্তান ভুগলেও চীনের সহায়তা নিয়ে এটিকে সামাল দিচ্ছে তারা। পাকিস্তানের সামরিক ব্যয়ের বড় অংশ ব্যয় হয় বৃহৎ সেনাবাহিনী ও পারমাণবিক অস্ত্রের সুরক্ষায়।
সাঁজোয়া যান
ভারতের ট্যাঙ্ক ৪ হাজার ৬১৪টি। সাঁজোয়া যান ১ লাখ ৫১ হাজার ২৪৮টি। কামান ৯ হাজার ৭১৯টি। বিশেষ বাহিনীর মধ্যে আছে প্যারা এসএফ, ঘাতক ফোর্স, এমএআরসিওএস।
পাকিস্তানের ট্যাংক ৩ হাজার ৭৪২টি। সাঁজোয়া যান ৫০ হাজার (আনুমানিক)। কামান ৪ হাজার ৪৭২টি (৩৭৫ স্বয়ংক্রিয় হাউইটজারসহ)। বিশেষ বাহিনীর মধ্যে আছে স্পেশাল সার্ভিস গ্রুপ (এসএসজি), এসএসজি নৌ ও স্পেশাল সার্ভিস উইং। এগুলো আকারে তুলনামূলক ছোট হলেও সমীহ করার মতো।
পারমাণবিক সক্ষমতা
ভারতের পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে ১৩০ থেকে ১৪০টি। অন্যদিকে পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্রের সংখ্যা ১৪০ থেকে ১৫০। ফলে পারমাণবিক দিক থেকে পাকিস্তানের সক্ষমতা ভারতের চেয়ে বেশি।
কৌশলগত জোট
ভারতের কৌশলগত জোটে রয়েছে ইসরায়েল, রাশিয়া ও ফ্রান্স। এছাড়াও রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ সমর্থনও। অন্যদিকে পাকিস্তানের রয়েছে চীনের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক।
ভারতের সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতি মার্কন্ডেয় কাৎ জিও নিউজে এক নিবন্ধ লেখেন। সেখানে তিনি বলেছেন, ভারত ও পাকিস্তান ব্যয়বহুল যুদ্ধের সামর্থ্য রাখে না। তাই উত্তেজনা কমিয়ে কূটনীতিতে মনোযোগ দেওয়া উচিত।
তিনি বলেন, ভারতের রাজনীতিবিদ, গণমাধ্যম ও অন্যান্য মহল হামলার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করেছে। অনেকেই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সামরিক হামলার ডাক দিয়েছেন। তবে এ বিষয়ে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন। প্রথমত, যুদ্ধ অত্যন্ত ব্যয়বহুল, আর ভারত ও পাকিস্তান—দুটি দেশই দরিদ্র, যারা এ ধরনের ব্যয়বহুল যুদ্ধ চালাতে অক্ষম।
দ্বিতীয়ত, যুদ্ধের ফলাফল অনিশ্চিত। যুদ্ধ শুরু করা সহজ, কিন্তু শেষ কোথায় গিয়ে ঠেকবে, তা বলা অসম্ভব। নেপোলিয়ন ও হিটলার রাশিয়া আক্রমণ করেছিলেন দ্রুত জয়ের প্রত্যাশায়, কিন্তু তাদের পরিণাম সবাই জানে। তৃতীয়ত, ভারত ও পাকিস্তান উভয়ই পারমাণবিক শক্তিধর দেশ।
সুতরাং যুদ্ধের কথা বলা নিরেট অবিবেচকের কাজ। আমার মতে, ২০১৯ সালের পুলওয়ামা হামলার পর ভারতে যে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল, সেটিই সবচেয়ে বিচক্ষণ পথ।