৭ বছর পর ছাত্রলীগের নির্যাতনের ‘নির্মম গল্প’ লিখলেন কানাডায় পিএইচডিরত শিক্ষার্থী
- টিডিসি ডেস্ক
- প্রকাশ: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০:৫৩ AM , আপডেট: ০৪ মে ২০২৫, ০২:৩৮ AM

ছাত্র-জনতার গণ-অভুথ্যানের মুখে গত ৫ আগস্ট বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে পালিয়ে ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। মূলত এর পর থেকেই দল আওয়ামী লীগ কর্মীদের বিভিন্ন কুকর্ম সাধারণ মানুষের সামনে আসছে। উঠে আসছে দলটির ভাতৃপ্রতিম ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের ভয়াবহ নির্যাতনের গল্পও। নিজের সঙ্গে ঘটনা এমনি একটি ‘নির্মম গল্প’ লিখেছেন কুয়েটের লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ১৩ ব্যাচের শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহ নাঈম; বর্তমানে যিনি কানাডার লাভাল ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি করছে। গল্পটি প্রকাশ করেছে ‘সোচ্চার । Torture WatchDog Bangladesh’ নামে একটি ফেসবুক পেজ।
আব্দুল্লাহ নাঈমের লেখা ওই পোস্টে বলা হয়েছে, পৃথিবীতে সবচেয়ে ভারী বস্তু নাকি পিতার কাঁধে সন্তানের লাশ। নিজের আঘাতের যন্ত্রণার চেয়ে আমার বাবাকে এই অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে যেতে হবে ভাবতেই বেশি কষ্ট হচ্ছিলো। এর মধ্যেই বিইসিএম ১৩ ব্যাচের তারেক রড দিয়ে আমার মাথায় এবং আইইএম ১৪ ব্যাচের সামি চোখে আঘাত করলে জ্ঞান হারাই। জ্ঞান ফিরলে দেখি আমি খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট) মেডিকেল সেন্টারে।
খুব সাধাসিধে একটি জীবনের স্বপ্ন ছিল আমার। মা-বাবা আর আমাদের দুই ভাই-বোনের ছোট সংসার। অন্যসব মধ্যবিত্ত পিতার মত আমার বাবাও নিজের ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার ব্যর্থ স্বপ্নটি আমাকে দিয়ে পূরণ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এর মূল্য কুয়েট আমাকে এভাবে দেয়াবে সেটা আমরা কেউই কল্পনা করিনি।
আমি আইডিয়াল স্কুল এন্ড কলেজ থেকে এসএসসি এবং বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ রাইফেলস পাবলিক কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করি। এরপর কুয়েট ও রুয়েট দুটোতেই ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাই। কিন্তু কুয়েটের সেশনজটমুক্ত এবং পরিচ্ছন্ন ক্যাম্পাস আমার কাছে ভালো লেগেছিল। তাই কুয়েটে লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে ভর্তি হয়ে যাই।
২০১৪ সালে যখন আমি ভর্তি হই তখন কুয়েটের তৎকালীন আওয়ামীপন্থি ভিসি ড. মোহাম্মদ আলমগীরের (সদ্য পদত্যাগকারী ইউজিসি চেয়ারম্যান) ছত্রছায়াতে ছাত্রলীগ ক্যাম্পাস ও প্রতিটি হলে ছাত্র ও শিক্ষকদের উপর বিভিন্নভাবে দমনপীড়ন করতো। তবে ছাত্রলীগের মূল টার্গেট ছিল শিবিরের কর্মীরা। সাধারণ ছাত্রদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরির জন্য তারা জনসম্মুখে শিবির সন্দেহে ছাত্রদেরকে মারধর করত।
আমার জীবনের হিসেব-নিকেষ পাল্টে যায় ২০১৭ সালে। সৎ ও নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন জাতি গঠনে শিবিরের বিভিন্ন কর্মসূচি ভালো লাগায় আমি স্কুল থেকেই শিবিরের সাথে সম্পৃক্ত ছিলাম। কুয়েটেও ছাত্রদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে শিবির নানা ধরনের কর্মসূচি পালন করত।
পড়ুন: স্থবির পিএসসি, বেকায়দায় কয়েক লাখ চাকরিপ্রার্থী
কিছু বলার আগেই আমার মুখে লাথি মারে বঙ্গবন্ধু হলের ছাত্রলীগের সভাপতি সোহান। পায়ে জুতা নিয়েই আমার মুখে আঘাত করে সে। এরমধ্যে তখনকার ছাত্রলীগের সভাপতি মেকানিক্যাল-০৮ ব্যাচের সাফায়েত হোসেন নয়ন উপস্থিত হয়ে বেধড়ক চড় থাপ্পড় মারতে থাকে। আমার মনে হচ্ছিল তখনই যেন মাথার রগগুলো ছিঁড়ে যাবে।
ক্যারিয়ার গাইডলাইন সম্পর্কিত এমন একটি প্রোগ্রাম থেকে শিবিরের কিছু কর্মীকে আটক করে দৌলতপুর থানা পুলিশ। তখন ওই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ছিলেন এসএম আনোয়ার হোসেন। পুলিশ আটককৃত ছাত্রদের থেকে প্রাপ্ত কিছু তথ্য ছাত্রলীগের নেতাদের হাতে তুলে দেওয়ার পরই মূলত আমাদের অনেক ছাত্রের জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়ে। ছাত্রলীগ প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে হলগুলোতে সাঁড়াশি অভিযান চালায় এবং ছাত্রদেরকে হল থেকে ধরে নিয়ে নির্যাতন করতে থাকে।
এরই ধারাবাহিকতায় ১ মে, ২০১৭ তারিখ রাতে আমার একজন ব্যাচমেট বিইসিএম ১৩ ব্যাচের বিজয় বাশার তার আরেকজন জুনিয়রকে সাথে নিয়ে বঙ্গবন্ধু হলে আমার আবাসিক কক্ষ পূর্ব-৩১০ থেকে আমাকে ডেকে নিয়ে যায়। সাথে আমার ল্যাপটপ ও বাটন ফোন। তাদের সাথে হলের গেস্টরুমে গিয়ে কয়েকজনকে রক্তাক্ত ও আশঙ্কাজনক অবস্থায় দেখতে পাই। আমার আগেই সেখানে অনেককে ডেকে নেওয়া হয়েছিল।
তখন রাত প্রায় বারোটা। গেস্টরুমে উপস্থিত ছিল বিইসিএম ১৩ ব্যাচের তারেক হাসান (এখন সে আমেরিকাতে আছে), বিইসিএম ১৩ ব্যাচের সোহানুর রহমান (বঙ্গবন্ধু হলের সভাপতি), আইইএম ১৪ ব্যাচের সামিউর রহমান ও সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং ১২ ব্যাচের আবির রহমান স্বপ্নীল, সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং ১৩ ব্যাচের শরফুদ্দিন। শরফুদ্দিন জোরপূর্বক ল্যাপটপের পাসওয়ার্ড নিয়ে ল্যাপটপ খুলে সার্চ করে এবং অন্যরা শিবির করি কিনা জিজ্ঞাসা করে।
কিছু বলার আগেই আমার মুখে লাথি মারে বঙ্গবন্ধু হলের ছাত্রলীগের সভাপতি সোহান। পায়ে জুতা নিয়েই আমার মুখে আঘাত করে সে। এরমধ্যে তখনকার ছাত্রলীগের সভাপতি মেকানিক্যাল-০৮ ব্যাচের সাফায়েত হোসেন নয়ন উপস্থিত হয়ে বেধড়ক চড় থাপ্পড় মারতে থাকে। আমার মনে হচ্ছিল তখনই যেন মাথার রগগুলো ছিঁড়ে যাবে।
ক্যাম্পাসে বাকি আট-দশ মাস আতঙ্কের মধ্যে ছিলাম। অবস্থা এতো নাজুক ছিল যে, কয়টায় আমার ক্লাস বা পরীক্ষা শেষ হবে তা ক্যাম্পাসে প্রবেশের পূর্বে পরিবারে জানিয়ে রাখতাম। নির্দিষ্ট সময়ের ১০ মিনিট পর যদি আমাকে কল দিয়ে পাওয়া না যায়; তাহলে শিক্ষক-বন্ধুবান্ধব ও থানাসহ যোগাযোগ করতে হবে- এটা জানিয়ে দিতাম।
পরক্ষণেই তারা সম্মিলিতভাবে আমার পিঠে ও পায়ে রড, জিআই পাইপ, হকি স্টিক আর স্টাম্প ইত্যাদি দিয়ে মারতে থাকে। এভাবে ১০-১২ মিনিট মারার পর তারা হাঁপিয়ে ওঠে। মনে হচ্ছিল আমি এখানে মারা গেলে পরদিন সকালে বাবাকে পৃথিবীর সবচেয়ে ভারী বোঝাটি বহন করতে হবে। যে কাঁধে ছোটোবেলায় উচ্ছ্বাসে চরেছিলাম সে কাঁধে ভর করে অন্তিমযাত্রায় শামিল হবো।
কিছুক্ষণ পর বিইসিএম ১৩ ব্যাচের তারেক আবার রুমে প্রবেশ করেই একটি রড নিয়ে আমার মাথায় আঘাত করে। একইসাথে আইইএম ১৪ ব্যাচের সামি আমার বাম চোখে আঘাত করে। তখন আমার চোখ এবং মাথা থেকে রক্ত গড়িয়ে ফ্লোরে পড়তে থাকে। বাবা আমার যে চোখে নিজের অপূর্ণ ইচ্ছা ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন, আমার চোখ ও মাথা থেকে গড়িয়ে পড়া প্রতিটি রক্তের ফোঁটার সাথে যেন সেই স্বপ্নের মৃত্যু ঘটছিল। আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।
তখন রাত তিনটা। জ্ঞান ফেরার পর নিজেকে কুয়েট মেডিকেল সেন্টারে আবিষ্কার করি। টের পাই বাইরে প্রচুর হট্টগোল হচ্ছে। তারা ইতোমধ্যে জানতে পারে আমি কুয়েট শিবিরের ক্যাম্পাস ওয়ার্ড শাখার সভাপতি। যেহেতু সন্দেহভাজন হিসেবে তারা আমাকে নির্যাতন করেছে, শিবিরের ওয়ার্ড শাখার সভাপতি হিসেবে তাদের কাছে সেটি খুবই কম ছিল। তারা আমাকে আবার তাদের টর্চার সেলে নিয়ে তাদের ভাষায় ‘আপ্যায়ন’ (নির্যাতন) করতে চায়। কিন্তু কুয়েট মেডিকেল সেন্টারের তৎকালীন দায়িত্বরত ডাক্তারের শক্ত অবস্থানের কারণে তারা আমাকে সে রাতে মেডিকেল সেন্টার থেকে বাইরে নিতে পারেনি।
রাতে করা আঘাতে আমার বাম চোখের নার্ভগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গিয়েছিল। এই চোখের কারণে আমার এখনো প্রায়ই মাথাব্যথা হয়। পিঠের আঘাতগুলো আমি এখনো বয়ে বেড়াচ্ছি। আমাকে যখন মেডিকেল সেন্টারে নিয়ে যাওয়া হয় তখন আমার হৃৎস্পন্দন ছিল ১০-১২, যেটি স্বাভাবিক মানুষের ৭২ বার হয়।
রাতে ব্যর্থ হয়ে পরেরদিন সকাল সাড়ে সাতটার দিকে বঙ্গবন্ধু হলের ইলেকট্রিক্যাল-১৩ এর রিয়ানের (দেশের বাড়ি চট্টগ্রামে) নেতৃত্বে একদল ছেলে আবারো মেডিকেল সেন্টারে প্রবেশ করে এবং আমাকে টেনেহিঁচড়ে গেস্টরুমে নিয়ে যায়। যাওয়ার পথে কোনো কথাবার্তা ছাড়াই রিয়ান আমাকে চড় মারতে থাকে যেন আমার প্রতি সে হাজার বছর ধরে তীব্র ঘৃণা পুষে রেখেছিল। তখন আমার মাথায় প্রচণ্ড ব্যথা করছিল আগের রাতের আঘাতের কারণে।
গেস্টরুমে গিয়ে দেখি কয়েকজন রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। তাদের জামাকাপড় ছেড়া ছিল। সেখানে আরো উপস্থিত ছিল ছাত্রলীগ আলী ইমতিয়াজ সোহান (মেকানিকাল-০৮), সোহানের ছোটভাই আলী ইবনুল সানি (আইইএম-১১) সহ অনেকেই। বঙ্গবন্ধু হলের তৎকালীন প্রভোস্ট ড. পল্লব (ইসিই ডিপার্টমেন্ট) সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তিনি নির্লজ্জভাবে ছাত্রলীগের পক্ষপাতিত্ব করছিলেন। তার সামনে এতোগুলো ছাত্রকে নির্দয়ভাবে মারা হলেও তিনি নির্লিপ্ত ছিলেন।
তৎকালীন ছাত্রকল্যাণ পরিচালক ড. সোবহান মিয়া সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তাদের উপস্থিতিতে এতগুলো নিরপরাধ ছাত্রকে মেরে রক্তাক্ত করা হলেও তারা ছাত্র নামধারী ছাত্রলীগের দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে আমাদেরকে পুলিশের হাতে সোপর্দ করেন।
পুলিশ আমাদেরকে ফুলতলা হেলথ কমপ্লেক্স থেকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে সেখান থেকে খান জাহান আলী থানায় নিয়ে যায়। তখন ঐ থানার ওসি ছিলেন আশরাফুল আলম। ছোট একটি সেলে আমরা ১২-১৩ জন অবস্থান করেছিলাম। এর পরে আমরা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসেরও শিকার হই। আমাদের নামে হাস্যকর কিছু মামলা দেওয়া হয় এবং একমাস কারাগারে আটকে রাখা হয়। সেগুলোর ঘানি এখনো টেনে বেড়াতে হচ্ছে।
পড়ুন: বিশ্বমঞ্চে মাহফুজকে ‘মাস্টারমাইন্ড’ আখ্যা দিলেন ড. ইউনূস (ভিডিও)
চলার পথে থমকে গেলেও আবার পথ চলা যায়, কিন্তু কখনোই আগের মতো সাবলীল হয় না। ছাত্রলীগের এই সন্ত্রাসীদের নির্যাতনের কারণে আমাদের অনেকের জীবনের স্বাভাবিক গতিপথ পাল্টে গেছে। কিন্তু নিজেকে গড়ার অপূর্ব সময়, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের অসাধারণ সময়গুলো উচ্ছলতার পরিবর্তে অজানা আশঙ্কায় কাটাতে হয়েছে আমাকে। ছাত্রলীগ আমার উপরে শুধুমাত্র এই কারণেই নির্যাতন করেছে যে আমি ভিন্ন আদর্শিক মত লালন করি। ক্যাম্পাসে আমরা তাদেরকে কোনো কাজে চ্যালেঞ্জ করেছিলাম এমনটাও না।
আমার জীবনের সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং ও কষ্টের পর্ব শুরু হয় জেল থেকে জামিন পাওয়ার পর। জেলে থাকাকালীন আমার নিজের ডিপার্টমেন্টের ছাত্রলীগ কর্মী রওশন জামিল (লেদার-১৩, বিসিএস ৪৩ এ পুলিশে সুপারিশপ্রাপ্ত) আমাদের ক্লাসের ফেসবুক গ্রুপে আমি সহ যাদেরকে নির্যাতন করা হয়েছিল তাদের ছবি আপলোড করে “আবার শিবির করলে ধড় থেকে মাথা আলাদা করা হবে” এই মর্মে হুমকিও দেয়।
স্বাভাবিকভাবেই, পরবর্তী অ্যাকাডেমিক জীবন আর সাবলীল থাকেনি। এই ঘটনার সময় আমি ৪র্থ বর্ষের ১ম সেমিস্টারে ছিলাম এবং অনেকগুলো ল্যাব-পরীক্ষা মিস হয়। করা হয়নি ইঞ্জিনিয়ারিং কারিকুলামের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যাটাচমেন্ট।
ক্যাম্পাসে বাকি আট থেকে দশ মাস যে সময়টুকু ছিলাম, সবসময় আতঙ্কের মধ্যে থাকতাম। এমনকি অবস্থা এতো নাজুক ছিল যে, কয়টায় আমার ক্লাস বা পরীক্ষা শেষ হবে তা ক্যাম্পাসে প্রবেশের পূর্বে আমার পরিবারকে কল দিয়ে জানিয়ে রাখতাম। নির্দিষ্ট সময়ের ১০ মিনিট পর যদি আমাকে কল দিয়ে পাওয়া না যায় তাহলে কুয়েটের শিক্ষক, আমার বন্ধুবান্ধব ও থানাসহ কোথায় কোথায় যোগাযোগ করতে হবে তা জানিয়ে দিতাম।
এই ধরনের পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে না গেলে কেউ অনুমানও করতে পারবে না একটি পরিবারকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছেলের একটা ডিগ্রি নেওয়ার জন্য কী পরিমাণ আতঙ্কে দিন কাটাতে হতে পারে। এই ঘটনার পর যতদিন আমি ভার্সিটিতে ছিলাম, কোনোদিন মা-বাবার মুখে হাসি দেখিনি। এটি সহ্য করা আমার জন্য সে রাতের মাথায় আঘাতের চেয়ে কম কষ্টের ছিল না।
পরীক্ষায় বসার জন্য যেহেতু ৬০% ক্লাসের শর্ত ছিল, গুনে গুনে আমি ৬০% ক্লাসে উপস্থিত থাকতাম। কারণ ক্যাম্পাসে প্রতিটি মুহূর্ত আমার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। যেদিন ছাত্রলীগের কোনো শোডাউন থাকত, আমার যত গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস-ল্যাবই থাকুক না কেন- সেদিন ক্যাম্পাসে যেতাম না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ দিনটিও ছিল আমার জন্য অনেক আশঙ্কার। ৩০ জানুয়ারি, ২০১৮। সেদিন ছিল কুয়েটে আমার শিক্ষাজীবনের (সেমিস্টার ৪-২) একেবারে শেষ দিকের একটি পরীক্ষা। পরীক্ষার সময় ছিল দুপুর ১টা থেকে বিকাল ৪টা। আমি ক্যাম্পাসে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। হঠাৎ খবর পাই সকালে দুইজন ছাত্রকে ছাত্রলীগের সভাপতি সিভিল-১০ এর আবুল হাসান শোভন (বর্তমানে LGED তে সহকারী প্রকৌশলী পদে কর্মরত) ও সেক্রেটারি সাদমান নাহিয়ান সেজানের (সিএসই-১৩) অনুসারীরা ক্লাস থেকে ধরে নিয়ে গেছে। এই বিষয়টি জানতে পেরে আমি ক্যাম্পাসে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই।
আমার আশঙ্কা হচ্ছিল, আবারও পরীক্ষার হলে বা আমার বাসায় হানা দিতে পারে। তাই আমি আমার ল্যাপটপ ও কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র নিয়ে এক বন্ধুর বাসায় চলে যাই। আমার আশঙ্কা সত্য হয়। শোভন ও সেজান দুপুর ২টার দিকে আমার বাসায় পুলিশ নিয়ে আসে, বাসার মালিকের সাথে খারাপ ব্যবহার করে এবং কোনো ওয়ারেন্ট ছাড়া নিজেরাই রুমের তালা ভাঙে। পরে জানতে পারি যে, পরীক্ষার হলেও ১০-১২ জন ছেলে আমাকে খোঁজ করেছিল। সে যাত্রায় আমি আল্লাহর রহমতে ওদের নির্যাতন থেকে বেঁচে গেলেও আমাদের শিক্ষাজীবন আবারও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আমি শেষ বর্ষের থিসিসের জন্য গবেষণাগারে করা যায় এমন কোনো প্রজেক্ট নিতে পারিনি। ক্যাম্পাসের বাইরে থেকে কোনো রকমে থিসিসের জন্য একটি প্রজেক্ট দাড় করাই। এমনকি জীবনহানির আশঙ্কা থেকে বিভাগীয় শিক্ষকদের পরামর্শ অনুসারে থিসিসের ফাইনাল প্রেজেন্টেশনও ব্যাচের অন্য সবার সাথে দিতে পারিনি। মাসখানেক পরে গোপনে আলাদা করে দিয়ে আসতে হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ দিনটিও ছিল আমার জন্য অনেক আশঙ্কার। ৩০ জানুয়ারি, ২০১৮। সেদিন ছিল কুয়েটে আমার শিক্ষাজীবনের (সেমিস্টার ৪-২) একেবারে শেষ দিকের একটি পরীক্ষা। পরীক্ষার সময় ছিল দুপুর ১টা থেকে বিকাল ৪টা। আমি ক্যাম্পাসে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। হঠাৎ খবর পাই সকালে দুইজন ছাত্রকে ছাত্রলীগের সভাপতি সিভিল-১০ এর আবুল হাসান শোভন (বর্তমানে LGED তে সহকারী প্রকৌশলী পদে কর্মরত) ও সেক্রেটারি সাদমান নাহিয়ান সেজানের (সিএসই-১৩) অনুসারীরা ক্লাস থেকে ধরে নিয়ে গেছে। এই বিষয়টি জানতে পেরে আমি ক্যাম্পাসে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই।
সবশেষে নিজের ওপর নির্যাতনকারীদের পরিচয় দিয়ে নাঈম লিখেছেন, ‘আমার ওপর সরাসরি নির্যাতনকারীরা হলো- ১. তারেক রহমান (বিইসিএম'১৩), NYC Human Resources Administration Department of Social Services, USA; ২. সামিউর রহমান (আইইএম'১৪), সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, Synesis IT PLC; ৩. সাফায়েত হোসেন নয়ন (মেকানিকাল'০৮), Engineer, United Delcot Water Ltd; ৪. সোহানুর রহমান (বিইসিএম'১৩), বাড়ি-পাবনা; ৫. আসাদুজ্জামান রিয়ান (ইইই'১৩), KSRM, Chittagong এবং ৬. আবির রহমান স্বপ্নীল (সিভিল'১২), Assistant Civil Engineer · Public Works Department (BCS-38)
নির্যাতনে সহায়তাকারী: ১. বিজয় বাশার (বিইসিএম'১৩), Engineer, Al-Muslim Builders, Dhaka; ২. শরফুদ্দিন শোয়েব (সিভিল'১৩); ৩. আলী ইমতিয়াজ সোহান, (মেকানিকাল'০৮), বাড়ি- টাঙ্গাইল; ৪. আলী ইবনুল সানি (আইইএম'১১), ইঞ্জিনিয়ার, ওয়ালটন গ্রুপ। প্রাণনাশের হুমকিদাতা: ১. রওশন জামিল, (লেদার'১৩), সুপারিশপ্রাপ্ত : পুলিশ- বিসিএস ৪৩, বাড়ি- রাজশাহী। মেসে হামলায় নেতৃত্বদানকারী : ১. আবুল হাসান শোভন, (সিভিল'১০), অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার, LGED ২. সাদমান নাহিয়ান সেজান (সিএসই'১৩), বাড়ি- চুয়াডাঙ্গা
নাঈমের বক্তব্য, চলার পথে থমকে গেলেও আবার পথ চলা যায়, কিন্তু কখনোই আগের মতো সাবলীল হয় না। ছাত্রলীগের এই সন্ত্রাসীদের নির্যাতনের কারণে আমাদের অনেকের জীবনের স্বাভাবিক গতিপথ পাল্টে গেছে। কিন্তু নিজেকে গড়ার অপূর্ব সময়, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের অসাধারণ সময়গুলো উচ্ছলতার পরিবর্তে অজানা আশঙ্কায় কাটাতে হয়েছে আমাকে। ছাত্রলীগ আমার উপরে শুধুমাত্র এই কারণেই নির্যাতন করেছে যে আমি ভিন্ন আদর্শিক মত লালন করি। ক্যাম্পাসে আমরা তাদেরকে কোনো কাজে চ্যালেঞ্জ করেছিলাম এমনটাও না।
এক অবিচার অন্য আরো অনেক অবিচারের রাস্তা খুলে দেয়। পরবর্তীতে কুয়েটে ছাত্রলীগের অত্যাচারে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের মৃত্যু, আরো অসংখ্য সাধারণ ছাত্রদের নির্যাতিত হতে হয়েছে। রাজনীতির নামে সন্ত্রাসীদের এই দৌরাত্ম্য বন্ধ না হলে বাংলাদেশের কোনো ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা ও শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না।
গল্পটি প্রকাশ করে সোচ্চার তাদের পেজে ফুটনোট হিসেবে লিখেছে, নাঈমের উপরে নির্যাতনের ঘটনার সত্যতা ও নির্যাতনের সময়ে অভিযুক্তদের সম্পৃক্ততা 'সোচ্চার' এর পক্ষ থেকে যাচাই করা হয়েছে এবং তখন কিছু মিডিয়াতেও প্রকাশিত হয়েছিলো। তবে নির্যাতনে তাদের সুনির্দিষ্ট ভূমিকা ভিক্টিমের জবানবন্দি ছাড়া অন্য কোনো উপায়ে যাচাই করা যায়নি এবং অভিযুক্তদের মন্তব্য নেওয়ার জন্য সোচ্চারের পক্ষ থেকে তাদের সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।