শাপলার রক্তাক্ত স্মৃতি

৫ মে ২০১৩-এর গণহত্যা ও রাষ্ট্রের নির্লজ্জ নীরবতা

লেখক
লেখক  © টিডিসি সম্পাদিত

বাংলাদেশের ইতিহাসে ৫ মে ২০১৩ একটি কালো অধ্যায়। এ দিন রাতের অন্ধকারে ঢাকার শাপলা চত্বরে যে গণহত্যা সংঘটিত হয়, তা শুধু একটি নিরীহ সমাবেশ দমন নয়—এটি ছিল রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের নগ্ন প্রকাশ। ইসলামী মূল্যবোধ ও নৈতিকতা রক্ষার দাবিতে শান্তিপূর্ণভাবে অবস্থান নেওয়া হাজার হাজার ধর্মপ্রাণ মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। প্রায় এক যুগ পরও এই ঘটনার বিচার হয়নি, হয়নি কোনো জবাবদিহিতা। বরং সরকার এবং সংশ্লিষ্ট মহল এই ঘটনার সত্যতা আড়াল করতে সচেষ্ট থেকেছে, যা গণতন্ত্র, মানবাধিকার এবং ন্যায়বিচারের প্রতি ভয়ানক এক অবহেলার বহিঃপ্রকাশ। আজ, এক যুগ পরে, এসব প্রশ্ন আরও তীব্র হয়ে উঠেছে।

ঘটনার পটভূমি
২০১৩ সালের গোড়ার দিকে দেশে এক বিশৃঙ্খল রাজনৈতিক ও ধর্মীয় পরিস্থিতি চলছিল। একদিকে জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের বিতর্কিত ট্রাইব্যুনাল দিয়ে যুদ্ধাপরাধের বিচার, অন্যদিকে কিছু ব্লগারদের ইসলামের বিরুদ্ধে অবমাননাকর মন্তব্য—সব মিলিয়ে দেশের ধর্মপ্রাণ জনগণের মধ্যে চরম ক্ষোভ তৈরি হয়। এই প্রেক্ষাপটে গঠিত হয় হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। সংগঠনটি ১৩ দফা দাবি তুলে ধরে, যার মধ্যে ইসলাম অবমাননার বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রণয়ন, নারী নীতিমালা বাতিল এবং নাস্তিক ব্লগারদের শাস্তির দাবি ছিল অন্যতম।

৫ মে ২০১৩, লক্ষাধিক মানুষ রাজধানীর শাপলা চত্বরে সমবেত হয় এই দাবিগুলোর পক্ষে। শান্তিপূর্ণ অবস্থান কর্মসূচি চলতে থাকে সারাদিনব্যাপী। কিন্তু মধ্যরাতের পর শুরু হয় ইতিহাসের এক ভয়াবহতম দমনপীড়ন।

মধ্যরাতের নারকীয়তা
রাত প্রায় ২টা—ঢাকা শহর বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন, মোবাইল নেটওয়ার্ক অকার্যকর, টেলিভিশন চ্যানেলগুলো সংবাদ সম্প্রচারে বাধাগ্রস্ত। ঠিক এই মুহূর্তে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী শুরু করে ‘অপারেশন শাপলা। শত শত পুলিশ, র‍্যাব, বিজিবি, এবং জলকামান, সাউন্ড গ্রেনেড, কাঁদানে গ্যাস ও সরাসরি গুলি ব্যবহার করে অবস্থানরত হাজার হাজার মানুষকে ছত্রভঙ্গ করে। চারদিক থেকে ঘিরে ফেলা হয় শাপলা চত্বর—যেন এক বন্দি নগরীর রূপ নেয়।

সাক্ষাৎকার এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ অনুযায়ী, রাস্তায় পড়ে থাকা মৃতদেহগুলোর পরিচয়হীন অবস্থায় পরিষ্কার করে ফেলা হয় রাতের মধ্যেই। লাশ গুম, গণকবরে دفন, এবং স্বজনদের লাশ খুঁজে না পাওয়ার অভিযোগ ওঠে।

নিহতের সংখ্যা ও তথ্য গোপনের সংস্কৃতি
সরকারিভাবে দাবি করা হয়, ওই রাতে মাত্র ১১ জন নিহত হয়। কিন্তু বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা এবং মানবাধিকার সংগঠন যেমন Human Rights Watch, Amnesty International—তাদের রিপোর্টে উল্লেখ করা হয় শতাধিক প্রাণহানির কথা। হেফাজতে ইসলাম এবং অন্যান্য উৎস থেকে দাবি করা হয় নিহতের সংখ্যা ১,০০০ ছাড়িয়ে যেতে পারে।


এই সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও যে বিষয়টি সবচেয়ে উদ্বেগজনক তা হলো—রাষ্ট্রের প্রচেষ্টায় এই গণহত্যার সত্যতা আড়াল করা হয়েছে। লাশ গুম, সাংবাদিকদের প্রবেশে বাধা, মিডিয়া ব্ল্যাকআউট, এবং পরবর্তীতে ভয়ভীতি দেখিয়ে ঘটনাটিকে চাপা দেওয়ার কৌশল সবই রাষ্ট্রীয় দমননীতির উদাহরণ।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও নীরবতা
৫ মে’র ঘটনার পরপরই আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। তবে পশ্চিমা বিশ্বের বহু রাষ্ট্র এ বিষয়ে দীর্ঘমেয়াদি চাপ প্রয়োগ করেনি, বরং অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক স্বার্থে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক অটুট রেখেছে। এর ফলে গণহত্যার বিচার কিংবা স্বচ্ছ তদন্তের কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি।

রাষ্ট্র বনাম নাগরিক: ন্যায়বিচারের সংকট
শাপলা চত্বরের হত্যাযজ্ঞ রাষ্ট্র ও নাগরিকের সম্পর্ককে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নাগরিকদের শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ ও সমাবেশের অধিকার থাকা উচিত। কিন্তু এই ঘটনার মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে যে, রাষ্ট্র যখন ক্ষমতার চরমে, তখন সে নিজেদের স্বার্থে নিরীহ জনগণের রক্ত ঝরাতেও দ্বিধা করে না।


শুধু তাই নয়, এই ঘটনার পর হেফাজতের অনেক নেতাকর্মী গ্রেফতার, নির্যাতন, এবং হয়রানির শিকার হয়েছেন। তাদের পরিবারগুলো নিরাপত্তাহীনতায় দিন কাটিয়েছে। অন্যদিকে হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনাকারীরা remained untouched—রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় তারা আজও বহাল তবিয়তে।

শাপলা হত্যাযজ্ঞ: রাষ্ট্রীয় নিষ্ঠুরতার জ্যান্ত দলিল
রাতের অন্ধকারে ঢাকাকে বিদ্যুৎ ও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে, সংবাদমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করে রাষ্ট্র যে অপারেশন চালায়, তা ছিল মানবাধিকারের চূড়ান্ত লঙ্ঘন। বহু মানুষ শহিদ হন, অনেক লাশ গুম হয়, এবং পরদিন সকালেই শাপলা চত্বর “পরিষ্কার ঘোষিত হয়—যেন কিছুই ঘটেনি।

এই নৃশংসতার পরও আজ পর্যন্ত একটি স্বাধীন কমিশন গঠিত হয়নি, কোনো তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ হয়নি, এমনকি রাষ্ট্রীয় স্বীকারোক্তিও পাওয়া যায়নি। এটি আমাদের বিচারব্যবস্থার গভীর সংকট এবং দমননীতির চূড়ান্ত প্রকাশ।

স্মৃতি ও প্রতিবাদ: আমাদের করণীয়
২০২৫ সালে দাঁড়িয়ে যখন আমরা পেছনে তাকাই, তখন প্রশ্ন আসে—এই ১২ বছরে আমরা কী শিখেছি? গণহত্যার বিচারহীনতা কি আমাদেরকে একটি নির্মম ও নিষ্ঠুর সমাজে রূপান্তরিত করছে না? ইতিহাস চেপে রাখা যায় না, যেমনটি আমরা একাত্তরের গণহত্যা নিয়ে বলি, তেমনি শাপলার রাতও ইতিহাসের অংশ। এই ঘটনার স্বচ্ছ তদন্ত, নিহতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ, এবং দোষীদের বিচারের আওতায় আনা না হলে রাষ্ট্রের প্রতি নাগরিকের আস্থা ফিরবে না।

আমাদের উচিত এই দিনটিকে প্রতিবাদের প্রতীক হিসেবে স্মরণ করা, যেন আগামীতে কোনো সরকার বা ক্ষমতাবান গোষ্ঠী গণআন্দোলন দমনের জন্য এভাবে রক্তপাত ঘটাতে সাহস না পায়। শাপলার শহিদদের স্মৃতি আমাদের মনে করিয়ে দেয়, স্বাধীনতা ও ন্যায়ের সংগ্রামে জনগণের জীবন সস্তা নয়।

শাপলা হত্যাযজ্ঞের সুষ্ঠু তদন্তপূর্বক দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনা এ সময়ের আবশ্যকীয় দাবি।

বিচারিক সংস্কৃতির বাস্তবতা ও সংকট
শাপলা হত্যাকাণ্ড ও এরপরের বিচারহীনতা আমাদের বিচারিক সংস্কৃতির গভীরতম অসারতা তুলে ধরে। একটি রাষ্ট্রে আইনের শাসন মানে হলো—ক্ষমতাবান হোক বা সাধারণ নাগরিক, সবার জন্য একই বিচার প্রক্রিয়া। কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতা হলো, রাষ্ট্র নিজেই অপরাধ করলে তার বিচার হয় না। এই বিচারহীনতা কেবল শাপলার ক্ষেত্রেই নয়—বিডিআর হত্যাকাণ্ড, নারায়ণগঞ্জে ৭ খুন, রানা প্লাজা ধস, প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমরা একই ধারাবাহিকতা দেখতে পাই।

শাপলা গণহত্যার তদন্ত হয়নি, দায়ী কেউ বিচারের মুখোমুখি হয়নি, নিহতদের পরিবার আজও কোনো ক্ষতিপূরণ বা স্বীকৃতি পায়নি। এ ধরনের ঘটনা শুধু দেশের অভ্যন্তরীণ ন্যায়বিচার ব্যবস্থাকে নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমাদের রাষ্ট্রের গ্রহণযোগ্যতাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে।

আমাদের প্রত্যাশা: ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্রগঠন ও জবাবদিহিতার সংস্কৃতি
১. স্বাধীন তদন্ত কমিশন: ৫ মে গণহত্যা নিয়ে নিরপেক্ষ ও আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন একটি বিচারিক কমিশন গঠন হোক, যাতে ঘটনার পূর্ণ সত্য উদ্‌ঘাটিত হয়।

২. গণহত্যা দিবস ঘোষণা: ৫ মে দিনটিকে রাষ্ট্রীয়ভাবে “গণহত্যা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হোক, এবং শহিদদের নাম-পরিচয় ও স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া হোক।

৩. বিচারিক সংস্কারে ধর্মীয় মূল্যবোধের সংযুক্তি: শুধু আইন নয়, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় ইসলামী নৈতিকতা ও হালাল-হারামের বোধ অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি।

৪. রাষ্ট্রীয় সেনা ও বেসামরিক নৈতিক ঐক্য: ৫ মের মতো অন্যায়ের প্রতিবাদে ‘জুলাই অভ্যুত্থান’-এর যে সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল, সেটি প্রমাণ করে রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্তরে এখনো ন্যায় ও ধর্মের পক্ষের চেতনা বেঁচে আছে। এই বিবেকবান অংশগুলোর একটি সম্মিলিত অবস্থান রাষ্ট্রগঠনের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে।

৫. ইসলামী নেতৃত্বের ঐক্য ও দূরদর্শিতা: আগামী দিনের জন্য প্রয়োজন একটি আদর্শিক নেতৃত্ব যারা শাপলা শহিদদের আত্মত্যাগের যথাযথ মূল্যায়ন করে বাস্তবসম্মত রাষ্ট্রভিত্তিক পরিবর্তনের পথ রচনা করতে পারবে।

৫ মে শাপলা গণহত্যা ও সম্ভাব্য জুলাই অভ্যুত্থান আমাদের দেখিয়েছে, রাষ্ট্রীয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে মানুষের প্রতিবাদ কখনো থেমে থাকে না। তবে সেই প্রতিবাদ কতটা ফলপ্রসূ হবে, তা নির্ভর করে আমাদের বিচারিক সংস্কৃতি, নেতৃত্বের দূরদর্শিতা এবং ধর্মীয় মূল্যবোধভিত্তিক রাষ্ট্র চেতনার উপর।

আজকের প্রত্যাশা—গণহত্যার বিচার, জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা, এবং একটি ইসলামী মূল্যবোধনির্ভর সুবিচারপূর্ণ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা। শহিদদের আত্মত্যাগ যেন একটি নতুন বাংলাদেশ গঠনের ইটপাথর হয়ে ওঠে—এই হোক আমাদের অঙ্গীকার।

লেখক: বিএ অনার্স, এম এ, এম.ফিল (গবেষক), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং তরুণ চিন্তক, সমাজকর্মী ও ‘জুলাই ২৪ অভ্যুত্থানের অন্যতম সংগঠক


সর্বশেষ সংবাদ