গাজওয়াতুল হিন্দ ও পানিনির্ভর ভূরাজনীতি: ভৌগলিক সংকটে কি বাংলাদেশ?

ফায়াজুন্নেসা চৌধুরী
ফায়াজুন্নেসা চৌধুরী  © টিডিসি ফটো

আজকের পৃথিবীতে মুসলিম উম্মাহ নানা রকম আদর্শিক, সামাজিক ও ভূরাজনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। কিছু সংকট এসেছে আমাদের ভেতরকার বিভাজন থেকে, আবার কিছু এসেছে জলবায়ু পরিবর্তন, সীমান্ত সমস্যা, ও প্রাকৃতিক সম্পদ নিয়ে বৈষম্যপূর্ণ আচরণ থেকে। এই প্রবন্ধে আলোচ্য বিষয় দুটি— ইসলামি ভবিষ্যদ্বাণী গাজওয়াতুল হিন্দ ও বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যকার পানি সংকট— বর্তমান পরিস্থিতিতে মুসলিম বিশ্বকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার যে জরুরি আহ্বান জানাচ্ছে, তা বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

গাজওয়াতুল হিন্দ: একটি ধর্মীয় ধারণা
গাজওয়াতুল হিন্দ শব্দটি ইসলামী হাদীসে এসেছে, যেখানে বলা হয়েছে যে কিয়ামতের নিকটবর্তী সময়ে মুসলমানদের একটি দল ভারতের দিকে অভিযান চালাবে এবং বিজয় লাভ করবে। একটি হাদীসে বলা হয়েছে:

‘আমার উম্মতের দুটি দলকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করা হবে: একটি হবে হিন্দ জয়কারী দল এবং অপরটি হবে ঈসা ইবনে মারইয়ামের সঙ্গে থাকা দল।’ (সুনান আন-নাসাঈ)

এ হাদীসগুলোর সনদের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে ইসলামি স্কলারদের মধ্যে ভিন্ন মত আছে। কেউ এগুলোকে আধ্যাত্মিক বিজয় হিসেবে ব্যাখ্যা করেন, কেউ আবার ভবিষ্যতের সম্ভাব্য সংঘাতের প্রতীক মনে করেন। কিন্তু এটি অস্বীকার করার উপায় নেই যে, এই ধারণাটি একটি শক্তিশালী ধর্মীয় প্রভাব বিস্তার করে মুসলিম সমাজে।

দক্ষিণ এশিয়ার পানি সংকট: বাংলাদেশ-ভারত বিরোধ
বাংলাদেশ একটি নদীমাতৃক দেশ হলেও এর অধিকাংশ নদীর উৎস ভারতের ভেতরে। প্রায় ৯৩% নদীই সীমান্তের বাইরে থেকে আসে। এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত হলো তিস্তা নদী। দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে আলোচনা চললেও তা এখনো চূড়ান্ত রূপ পায়নি। ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের আপত্তির কারণে এই চুক্তি স্থগিত রয়েছে।

ফলে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে শুষ্ক মৌসুমে পানি সংকট মারাত্মক রূপ ধারণ করছে, কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, এবং মানুষের জীবনমান বিপন্ন হচ্ছে। শুধু তিস্তা নয়, ব্রহ্মপুত্র, গঙ্গা ও অন্যান্য নদীকেও কেন্দ্র করে বড় আকারের পরিবেশগত ও কূটনৈতিক সমস্যা তৈরি হতে পারে।

মুসলিম বিশ্বের ঐক্য এখন সময়ের দাবি

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, যখন মুসলমানরা ঐক্যবদ্ধ ছিল, তখন তারা জ্ঞান, ন্যায়বিচার ও নেতৃত্বে বিশ্বকে পথ দেখিয়েছে। কিন্তু আজ মুসলিম বিশ্ব বিভক্ত — মাজহাব, জাতীয়তাবাদ, ও বিদেশি প্রভাবের কারণে। বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার মতো স্পর্শকাতর অঞ্চলে এই বিভাজন আরও বিপজ্জনক।

বাংলাদেশ যেমন মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র, তেমনি পাকিস্তান, ইরান, তুরস্ক, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব ও অন্যান্য মুসলিম রাষ্ট্র একত্রিত হয়ে একটি "ইসলামি পানি জোট" (Islamic Water Alliance) গঠন করতে পারে— উদ্দেশ্য হবে যৌথ কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টি করা, পানি বণ্টনে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা, ও দক্ষিণ এশিয়ার পানিনির্ভর সংঘাত প্রতিরোধ করা।

ইসলাম ও ন্যায়বিচারের দায়িত্ব

আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেন, ‘আল্লাহ তোমাদের আদেশ দেন, যে ব্যক্তি উপযুক্ত, তার কাছে আমানত পৌঁছে দিতে এবং মানুষের মধ্যে ন্যায়বিচার অনুযায়ী রায় দিতে।’ (সূরা আন-নিসা, ৪:৫৮)

পানি একটি আমানত, এবং এর ন্যায্য বণ্টন ইসলামের নীতির সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত। কোনো জাতিকে পানির প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করা যেমন অন্যায়, তেমনি মুসলিম নেতৃত্বের জন্য এটি একটি আত্মিক ও নৈতিক ব্যর্থতা।

আজকের গাজওয়া: যুদ্ধ নয়, টিকে থাকার সংগ্রাম
আজকের দিনে যদি কোনো গাজওয়া হয়ে থাকে, সেটি হওয়া উচিত পানি সংকট, জলবায়ু বিপর্যয়, ও প্রাকৃতিক সম্পদ দখলের বিরুদ্ধে। মুসলিম বিশ্বকে যুদ্ধের জন্য নয়, বরং শান্তিপূর্ণ ও ন্যায়সংগত ভবিষ্যতের জন্য ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। ইসলামি ঐক্যই হতে পারে সেই প্ল্যাটফর্ম, যার মাধ্যমে আমরা আন্তর্জাতিক পানি মঞ্চে কথা বলতে পারি, ভাগাভাগির নীতির ভিত্তিতে প্রতিবেশীদের সঙ্গে সমঝোতা করতে পারি।

বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই জলবায়ু কূটনীতিতে নেতৃত্ব দেখিয়েছে। যদি বৃহত্তর মুসলিম বিশ্ব পাশে দাঁড়ায়, তবে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার পানি কূটনীতিতে একটি রোল মডেল হয়ে উঠতে পারে।

উপসংহার
মুসলিম ঐক্যের আহ্বান আজ আর শুধু ধর্মীয় নয়— এটি এখন একটি ভূরাজনৈতিক ও পরিবেশগত প্রয়োজন। আরব মরুভূমি থেকে শুরু করে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল পর্যন্ত মুসলিম উম্মাহকে আজ একসাথে কাজ করতে হবে।

গাজওয়াতুল হিন্দ আমাদের অনুপ্রাণিত করুক শুধু বিজয়ের জন্য নয়, বরং রক্ষা ও সংরক্ষণের জন্য। পানি, ভূমি, অধিকার এবং ঐক্য— এগুলো রক্ষার মধ্যেই নিহিত রয়েছে মুসলিম বিশ্বের সত্যিকারের দায়িত্ব ও ভবিষ্যৎ। 

লেখক: শিক্ষক, সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপান্টমেন্ট, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি ও পিএইচডি রিসার্চার, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়


সর্বশেষ সংবাদ