ফেসবুকে মত প্রকাশ, শিক্ষিকা লাকী খাতুনকে কেন হয়রানি করা হবে?

কল্লোল মোস্তফা
কল্লোল মোস্তফা  © টিডিসি সম্পাদিত

সম্প্রতি কুড়িগ্রামের কচাকাটা কলেজের ফাইনান্স ও ব্যাংকিং বিভাগের প্রভাষক লাকী খাতুন ফেসবুকে নারীর পর্দা প্রথার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে একটি পোস্ট দিয়েছিলেন। পোস্টটি নিয়ে স্থানীয়দের মাঝে তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হলে তিনি সেটা ডিলিট করেন এবং ক্ষমা প্রার্থনা করে ফেসবুকে পোস্ট দেন ও লাইভ করেন। তারপরেও তাকে নিয়ে রাতে এলাকাবাসী ও ধর্মীয় মুরব্বিদের সালিশ বসে। সালিশের শুরুর দিকেই লাকী খাতুন ‘ভুল’ স্বীকার করে ক্ষমা চেয়েছেন, তারপরেও তাকে বারবার তার মনোভাব, ভবিষ্যৎ করণীয় ইত্যাদি বিষয়ে জানতে চাওয়া হতে থাকে। পুরো বিষয়টা সালিশের নামে হয়রানি বলেই মনে হয়েছে। ফেসবুকে মত প্রকাশ করবার জন্য এই ধরনের হয়রানির নিন্দা জানাই।

আরেকটা বিষয় হলো, সালিশের ফেসবুক লাইভে দেখলাম সালিশকারীরা লাকী খাতুনের প্রোফাইলের ইন্ট্রোতে থাকা কবিতার দুটো বাক্য নিয়ে ইন্টারেস্টিং ব্যাখ্যা দিয়েছেন। বাক্য দুটো হলো: ‘কোথায় স্বর্গ কোথায় নরক কে বলে তা বহুদূর,/ মানুষের মাঝে স্বর্গ নরক মানুষেতে সুরাসুর’। সালিশের লাইভ থেকে দেখা যাচ্ছে, একজন বেশ কনফিডেন্সের সাথে বলছেন, এখানে জান্নাতও অস্বীকার করতেছেন, জাহান্নামও অস্বীকার করতেছেন। এই কবিতার প্রত্যেকটা লাইন শিরকের সাথে যুক্ত। ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক। দ্বিতীয় লাইনে আছে মানুষের মাঝে স্বর্গ-নরক। এটা যৌন সেক্সের কথা বলছে। হিন্দুদের থেকে যারা বাউল হয়েছে তাদের এই কবিতা। মানুষের কাছ থেকে রস নিলে স্বর্গ পাইলেন আর ওখান থেকে ব্যথা পাইলে, আপনার সাথে প্রেম বিচ্ছিন্ন হইলে দু:খ পাইলেন। তার পরের শব্দটা একদম হিন্দুদের থেকে নেওয়া, মানুষেতে সুরাসুর। ওরা বলে সুর-অসুর। সুর বলে দেবতাদেরকে আর অসুর বলে শয়তানদেরকে।’ (লাইভ ভিডিওর ৮ মিনিট ৪০ সেকেন্ড থেকে ১১ মিনিট পর্যন্ত দ্রষ্টব্য)

কবিতাটি বিষয়ে লাকী খাতুন বলেছেন, স্কুলের পাঠ্যবইয়ে উনি কবিতাটি পড়েছেন। এখন এটা নিয়ে যদি আইনগত কোন পদক্ষেপ নিতে হয় তাহলে সালিশকারীরা যেন নেন। কিন্তু এর জন্য তাকে যেন দায়ী না করেন। সালিশকারীরা তখন লাকী খাতুনের কাছে জানতে চান, এখন যেহেতু তিনি জানলেন এই কবিতা ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক, তাই  তিনি এটা তার প্রোফাইল থেকে উইথড্রো করবেন কিনা। এই কবিতা বহু জায়াগায় যেহেতু আছে, তাই উনার প্রোফাইলে থাকার কোন যুক্তি তারা দেখেন না। লাকি খাতুন তখন কবিতাটি ডিলিট করবেন বলে জানান।

লাকী খাতুনের ফেসবুক প্রোফাইলের ইন্ট্রোতে থাকা বাক্য দুটি কবি ও সাহিত্যিক শেখ ফজলল করিমের লেখা ‘স্বর্গ ও নরক’ কবিতা থেকে নেওয়া। এই কবিতাটি  আমরা অনেকেই স্কুলে থাকতে পাঠ করেছি, ভাবসম্প্রসারণ করেছি।

কোথায় স্বর্গ, কোথায় নরক, কে বলে তা বহুদূর?
মানুষের মাঝে স্বর্গ-নরক, মানুষেতেই সুরাসুর।

রিপুর তাড়নে যখনি মোদের বিবেক পায় গো লয়,
আত্মগ্লানির নরক অনলে তখনি পুড়িতে হয়।

স্বর্গ আসিয়া দাঁড়ায় তখন আমাদেরই কুঁড়েঘরে।

কবিতার বাক্যগুলোর ভাবসম্প্রসারণ করতে গিয়ে আমরা তখন লিখতাম, মর্ত্যের পৃথিবীতেই মানুষ তার আচার-আচরণের মধ্য দিয়ে স্বর্গ ও নরকের দেখা পেতে পারে। কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্য এই সব রিপুর তাড়নায় মানুষ যখন বিবেক বুদ্ধি হারিয়ে অপকর্ম করে, তখন সে এমন অপরাধবোধে ভোগে যা তার জন্য নরকতুল্য। আবার মানুষ যখন পরস্পরের সাথে ভাল আচরণ করে, প্রেম-প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ হয়, তখন মানুষের সংসারেই স্বর্গের সুখ পাওয়া যায়।

কবিতাটি পড়বার সময় কখনোই মনে হয়নি ধর্মে বর্ণিত স্বর্গ নরক অস্বীকার করবার উদ্দেশ্যে বা ‘যৌন সেক্স’-কে প্রোমোট করবার উদ্দেশ্যে কবিতাটি লেখা হয়েছে। আমি জানি না, সালিশে যিনি বাক্য দুটোর ব্যাখ্যা করেছেন, তার মনে কি কারণে এমন ব্যাখ্যার উদয় হলো। আমার মতো যারা সাধারণ কারিকুলামে কবিতাটি পড়েছে, তাদের মাথায় এই ধরনের উদ্ভট ব্যাখ্যা উদয় হওয়ার কথা না।

লক্ষণীয় বিষয় হলো, শেখ ফজলল করিম আলোচ্য ‘স্বর্গ ও নরক’ কবিতাটি লিখেছিলেন বিশ শতকের গোড়ার দিকে। তিনি বসবাস করতেন তৎকালীন রংপুর জেলার কাকিনা গ্রামে। তার কাব্যভাবনা ও সাহিত্যসাধনা প্রধানত ধর্মীয় বোধ ও নীতি-চিন্তা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিল। তিনি ইসলাম ধর্মের আলোকে মুসলমানদের মধ্যে আদর্শ জীবনযাত্রা এবং নীতি-উপদেশ শিক্ষা দিতে চেয়েছেন। তিনি চিশতীয়া সুফিমতের সমর্থক ছিলেন।

বিশ শতকের গোড়ার দিকে কবি শেখ ফজলল করিম যখন রংপুরে বসে ‘স্বর্গ ও নরক’ কবিতাটি লিখছেন, তখন তাকে কোন বাধার মুখে পড়তে হয়েছিল কিনা জানি না। তবে তার একশ বছর পরে এসে রংপুরের কুড়িগ্রামের একটি কলেজের প্রভাষককে কবিতাটির দুটি লাইন ফেসবুকে লিখবার অপরাধে যে স্থানীয় মুরব্বিদের জেরার মুখে পড়তে হলো, ইসলাম বিরোধীতার দায়ে অভিযুক্ত হতে হলো এবং এক পর্যায়ে কবিতাটি ফেসবুক থেকে ডিলিট করবার অঙ্গীকার করতে হলো—এটা বাংলাদেশের সামাজিক পরিস্থিতি সম্পর্কে যে বার্তা দেয় তা যথেষ্ট উদ্বেগজনক।

লেখক: লেখক ও গবেষক


সর্বশেষ সংবাদ