বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউট
সায়েন্টিফিক অফিসার হতে আগ্রহ বেশি, থিসিস ছাড়া মেলে না পরীক্ষার অনুমতি
- আশরাফ আন-নূর
- প্রকাশ: ১৭ মার্চ ২০২৫, ১২:১৫ PM , আপডেট: ২২ এপ্রিল ২০২৫, ০৩:০৩ AM

১৯৮৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউট। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটিতে ২৫০ জন শিক্ষার্থী এবং ৯৯ জন শিক্ষক নিয়ে অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম চলছে। শিক্ষার্থীদের ভাষ্য, এখানে গবেষণার চেয়ে মেডিকেল সায়েন্টিফিক অফিসার হওয়ার দিকে আগ্রহ বেশি। সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটিতে সরেজমিনে গিয়ে মিলেছে এমন তথ্য।
জানা গেছে, এ বিশ্ববিদ্যালয়ে চতুর্থ বর্ষ থেকে গবেষণায় যুক্ত হন শিক্ষার্থীরা। থিসিস না থাকলে কোনও শিক্ষার্থীকে পরীক্ষায় অংশগ্রহণের অনুমতি দেওয়া হয় না। নানান ধরনের সঙ্কট থাকলেও এখানে সর্বোচ্চ মানের সেবা দেওয়ার চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
শিক্ষার্থীদের গবেষণায় আগ্রহ কম
অ্যাকাডেমিক কর্মকাণ্ড নিয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মারুফুর রহমান বলেন, দুর্ভাগ্যবশত আমাদের এখানে আন্তর্জাতিকভাবে কোনো কো-অপারেশন বা সহযোগিতা করা হয় না। কো-অপারেশন থাকলে গবেষণার গতি এবং মান উন্নত হতে পারত। দুঃখের বিষয়, এখানকার বেশিরভাগ শিক্ষার্থী গবেষণায় মনোযোগ দিতে চান না। তারা মেডিকেল সায়েন্টিফিক অফিসার হওয়ার প্রতি বেশি আগ্রহী।
গবেষণার কার্যক্রম তৃতীয় বর্ষ থেকে শুরু হয়, যেখানে মূলত থিসিস বিষয়টি হাতে নেওয়া হয়। তারপর চতুর্থ বর্ষে এই গবেষণার ব্যাপকতা আরও বৃদ্ধি পায়। যাতে শিক্ষার্থীরা গভীরভাবে বিষয়টি বিশ্লেষণ ও গবেষণা করতে পারে। পরবর্তীতে পঞ্চম বর্ষে শিক্ষার্থীরা এই থিসিসের ওপর পরীক্ষা দেন এবং পরীক্ষার মাধ্যমে এটি পূর্ণাঙ্গভাবে সম্পন্ন করা হয়।
এখানকার শিক্ষার্থীরা নিয়মিত স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক জার্নালগুলোয় গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ করে বলে জানান প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাডেমিক পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. মনির হোসেন। তিনি বলেন, এটি অ্যাকাডেমিক উৎকর্ষ ও গবেষণার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আমাদের প্রতিষ্ঠানে অ্যাকাডেমিক পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট মানদণ্ড অনুসরণ করা হয়।
সহকারী অধ্যাপক পদে নিয়োগের জন্য কমপক্ষে তিনটি, সহযোগী অধ্যাপক পদে চার-পাঁচটি এবং অধ্যাপক পদে উন্নীত হওয়ার জন্য পাঁচ-সাতটি গবেষণা প্রবন্ধ আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হওয়া বাধ্যতামূলক। এ নীতিমালা গবেষণার মানোন্নয়ন ও চিকিৎসা বিজ্ঞানে নতুন জ্ঞান সৃষ্টিকে উৎসাহিত করে।
তিনি বলেন, বিদেশি অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে আমাদের প্রতিষ্ঠানের যোগাযোগ রয়েছে। বিশ্বের কিছু শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়, জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয় (লন্ডন শাখা), হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইমপেরিয়াল কলেজ লন্ডন। এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আমাদের অ্যাকাডেমিক এবং গবেষণামূলক সম্পর্ক রয়েছে, যা শিক্ষার মান উন্নত করতে সাহায্য করে।
অ্যাকাডেমিক থিসিস বাধ্যতামূলক
শিক্ষার্থী মারুফুর রহমান বলেন,‘আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণত চতুর্থ বর্ষ থেকে গবেষণা শুরু হয় এবং সেখানে থিসিস লেখা বাধ্যতামূলক। থিসিস ছাড়া পরীক্ষায় অংশগ্রহণ সম্ভব নয়। তাই প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে থিসিস লেখার জন্য বাধ্যতামূলকভাবে কাজ করতে হয়। যদি কেউ থিসিস না লেখে, তবে তার পরীক্ষায় অংশগ্রহণের অনুমতি দেওয়া হয় না এবং সে পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবে না।’
এ বিষয়ে অ্যাকাডেমিক পরিচালক বলেন, এখানে এমডি শিক্ষার্থীদের জন্য থিসিস লেখা বাধ্যতামূলক। থিসিসের গবেষণা প্রক্রিয়াটি বেশ গুরুত্বসহকারে করা হয়। গবেষণার প্রথম ধাপে, সাধারণত ৩০ থেকে ৪০ জন শিক্ষার্থী প্রথমে থিসিস অংশে কাজ শুরু করে। এরপর তারা ক্লিনিক্যাল গবেষণার অংশে প্রবেশ করে এবং সেখানে আরও বিস্তারিত গবেষণা পরিচালনা করে।
সাধারণত, গবেষণার কার্যক্রম তৃতীয় বর্ষ থেকে শুরু হয়, যেখানে মূলত থিসিস বিষয়টি হাতে নেওয়া হয়। তারপর চতুর্থ বর্ষে এই গবেষণার ব্যাপকতা আরও বৃদ্ধি পায়। যাতে শিক্ষার্থীরা গভীরভাবে বিষয়টি বিশ্লেষণ ও গবেষণা করতে পারে। পরবর্তীতে পঞ্চম বর্ষে শিক্ষার্থীরা এই থিসিসের ওপর পরীক্ষা দেন এবং পরীক্ষার মাধ্যমে এটি পূর্ণাঙ্গভাবে সম্পন্ন করা হয়।
বিদেশি অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে আমাদের প্রতিষ্ঠানের যোগাযোগ রয়েছে। বিশ্বের কিছু শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়, জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয় (লন্ডন শাখা), হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইমপেরিয়াল কলেজ লন্ডন। এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আমাদের অ্যাকাডেমিক এবং গবেষণামূলক সম্পর্ক রয়েছে, যা শিক্ষার মান উন্নত করতে সাহায্য করে। -অধ্যাপক ডা. মো. মনির হোসেন, অ্যাকাডেমিক পরিচালক, বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউট।
এমবিবিএস ও এফসিপিএস কোর্সের ধাপ
অ্যাকাডেমিক পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. মনির হোসেন মেডিকেলের এমবিবিএস (MBBS) ও এফসিপিএস (FCPS) নিয়ে বিশ্লেষণ করে বলেন, এমবিবিএস কোর্স সাধারণত দুইটি ফেজে (Phase) বিভক্ত। ফেজ ‘এ’ (Phase A): এ পর্যায়ে শিক্ষার্থীরা চিকিৎসাবিজ্ঞানের মৌলিক বিষয়গুলো শেখেন। মানবদেহের গঠন ও কার্যপ্রণালী (Anatomy, Physiology, Biochemistry) সম্পর্কে গভীর জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি রোগ নির্ণয়ের মৌলিক ধারণা পাওয়া যায়। এ পর্যায়ে শিক্ষার্থীরা সাধারণ ল্যাবরেটরি স্কিল ও প্রাথমিক ক্লিনিক্যাল দক্ষতা অর্জন করে।
ফেজ ‘বি’ (Phase B): এ ধাপে শিক্ষার্থীরা ক্লিনিক্যাল চিকিৎসার দিকে এগিয়ে যান। মেডিসিন, সার্জারি, স্ত্রী ও প্রসূতিবিদ্যা (Obstetrics & Gynecology), শিশু চিকিৎসা (Pediatrics) ইত্যাদি বিষয়ে ব্যবহারিক শিক্ষা গ্রহণ করা হয়। সর্বশেষ ধাপে ইন্টার্নশিপের মাধ্যমে সরাসরি রোগীদের সেবা করার বাস্তব অভিজ্ঞতা লাভ করে।
তিনি আরও বলেন, এফসিপিএস কোর্সেও দুইটি পার্ট (Part) থাকে, যা ধাপে ধাপে চিকিৎসকদের বিশেষজ্ঞ হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়। ফার্স্ট পার্ট (First Part): এ পর্যায়ে শিক্ষার্থীরা উন্নততর চিকিৎসাবিজ্ঞান, রোগ ব্যবস্থাপনা ও মৌলিক জ্ঞান অর্জন করে থাকে। এটি মূলত ভবিষ্যতে নির্দিষ্ট একটি চিকিৎসা শাখায় বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রস্তুতিমূলক ধাপ হিসেবে কাজ করে।
অন্যদিকে সেকেন্ড পার্ট (Second Part): এখানে নির্দিষ্ট বিশেষায়িত চিকিৎসা শাখার গভীর জ্ঞান অর্জন করা হয়। কার্ডিওলজি, নিউরোলজি, অনকোলজি ইত্যাদি বিশেষায়িত চিকিৎসা ক্ষেত্রে উন্নততর প্রশিক্ষণ ও গবেষণার সুযোগ থাকে। এই ধাপ শেষে চিকিৎসকরা স্বাধীনভাবে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসা সেবা দিতে সক্ষম হন।
তিনি উল্লেখ করেন, মেডিকেল শিক্ষায় একজন শিক্ষার্থী ইন্টার্নশিপ (Internship) → রেসিডেন্সি (Residency) → ফেলোশিপ (Fellowship) → বিশেষজ্ঞ (Specialist) – এভাবে ধাপে ধাপে উন্নীত হন। এভাবে এমবিবিএস থেকে এফসিপিএস পেরিয়ে একজন চিকিৎসক ধীরে ধীরে বিশেষজ্ঞ হয়ে ওঠেন এবং চিকিৎসাসেবায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
আরো পড়ুন: হাবিপ্রবিতে ভর্তি পরীক্ষা শুরু ৫ মে, আবেদন ৭৩ হাজার
ক্লাসরুম সংকট ও সমাধান
শিক্ষার্থীরা ক্লাসরুম সংকট নিয়ে বলেন, তাদের ক্লাসরুমের সংখ্যা যথেষ্ট নয়। এ সংখ্যা বাড়ানো খুবই দরকার। বর্তমানে শিডিউল অনুযায়ী ক্লাস করা সম্ভব হচ্ছে না। প্রাকটিক্যাল ক্লাসের ক্ষেত্রে সাধারণত প্রথমে থিওরিটিক্যাল ক্লাস অনুষ্ঠিত হয়। তারপর প্রাকটিক্যাল ক্লাস শুরু হয়। প্রয়োজনীয় রুমের অভাবে এ প্রক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছে, যা শিক্ষার গুণগত মানের ওপর প্রভাব ফেলছে।
এ বিষয়ে অ্যাকাডেমিক পরিচালক বলেন, ‘লজিস্টিক সাপোর্টের ক্ষেত্রে জায়গার সংকট একটি বাস্তব সমস্যা। আমি দীর্ঘ ৫০-৫৩ বছর ধরে এই প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছি এবং বর্তমানে জায়গার সীমাবদ্ধতা স্পষ্ট। ভবিষ্যতে এর সম্প্রসারণের পরিকল্পনা করা হয়েছে। ইতোমধ্যে এ সংক্রান্ত কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন আছে।
ল্যাব সংকট এবং সমাধান
শিক্ষার্থীদের ল্যাব নিয়ে জিজ্ঞাসা করলে তারা জানান, বর্তমানে তাদের একটি অ্যাকাডেমিক ল্যাব রয়েছে। যেখানে প্রাকটিক্যাল ক্লাসের জন্য শিক্ষার্থীদের নিয়ে যাওয়া হয়। তবে এ ল্যাব ব্যবহারের সুযোগ সীমিত এবং প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই অপর্যাপ্ত। এ অবস্থায় ক্লাসরুম এবং ল্যাবের সংখ্যা বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, যাতে শিক্ষার্থীরা আরও ভালো সুবিধা পায়।
আরো পড়ুন: অন্তর্বর্তী প্রশাসনের অধীনে সাত কলেজ, হেডকোয়ার্টার কোথায় হবে জানা গেল
অ্যাকাডেমিক পরিচালক বলেন, ‘আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা হচ্ছে এখানকার গবেষণার উৎকর্ষ সাধনে ভূমিকা রাখা। তবে, বর্তমানে ব্যবহৃত ল্যাবটির সংখ্যা এবং সুবিধা গবেষণা ও শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য যথেষ্ট নয়। এর সমাধানে আমরা লজিস্টিক সাপোর্ট বৃদ্ধির পাশাপাশি অতিরিক্ত ল্যাব স্থাপন করার চিন্তা করছি।’
শিশুদের নিয়ে গবেষণা
শিক্ষার্থীদের এখানকার হাসপাতালে ভর্তি হওয়া শিশুদের নিয়ে গবেষণা কার্যক্রম কীভাবে করা হয় জিজ্ঞাসা করলে তারা বলে, তারা শিশুদের নিয়ে যে কাজটি করেন তা হলো- এখানে বিএসসি শিক্ষার্থীরা স্যাম্পল কালেকশন করে এবং সেগুলো নিয়ে শিশুদের ওপর গবেষণা পরিচালনা করে। এ গবেষণার মাধ্যমে শিশুদের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করা হয়।
অ্যাকাডেমিক পরিচালক বলেন, প্রাকটিক্যাল ক্লাস বলতে এখানে কিছু নেই, সব কিছু হাতে-কলমে করা হয়। শিক্ষার্থীরা সরাসরি রোগীদের কাছে গিয়ে তাদের প্রয়োজনীয় ব্যবহারিক পাঠ সম্পন্ন করে। এটি তাদের বাস্তব জ্ঞান অর্জনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি বলেন, আমাদের সফলতা হলো, বাংলাদেশের মেডিকেল শিক্ষার্থীদের প্রায় ৪০ শতাংশ আমাদের এখান থেকে প্রশিক্ষণ নেয়। সেই সঙ্গে ২০-৩০ শতাংশ শিক্ষার্থী বিএমএসএসইউ থেকে প্রশিক্ষণ নেয়। বাকিগুলো অন্যান্য জায়গা থেকে।