ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ও জিকা ভ্যাকসিন কবে আসতে পারে, জানাল আইসিডিডিআরবি

আইসিডিডিআরবির বিজ্ঞানী ড. মুহাম্মদ শফিউল আলম
আইসিডিডিআরবির বিজ্ঞানী ড. মুহাম্মদ শফিউল আলম

বাংলাদেশে প্রায় প্রতিবছরই বর্ষা মৌসুমে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়ে যায়। আতঙ্ক ছড়ায় চারদিকে। কেননা, প্রায় প্রতিবছরই ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে অনেক মানুষ মারা যায়। পাশাপাশি দেশে নতুন করে ভয় জাগাচ্ছে জিকা ভাইরাস ও চিকুনগুনিয়া।

ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া এবং জিকা—তিনটি রোগই এক ধরনের মশা বা এডিশ মশার মাধ্যমে ছড়ায়। এজন্য ভ্যাকসিন নিয়ে কাজ করছে নানা দেশ। বাংলাদেশও পিছিয়ে নেই। দেশে ভ্যাকসিন তৈরি জন্য কাজ করছে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র. বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি)। কবে নাগাদ ভ্যাকসিন আসতে পারে, মানুষ পেতে পারে, বর্ষা মৌসুম এলেই সবাই জানতে চায়।

আইসিডিডিআরবি বিজ্ঞানী ড. মুহাম্মদ শফিউল আলম দেশে ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া এবং জিকার ভ্যাকসিনের সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে বলেন, বর্তমানে চিকুনগুনিয়া ভ্যাকসিনের ওপর কাজ করা হচ্ছে না। কারণ এই ভ্যাকসিনটি সাধারণত জনসাধারণের জন্য নয় বরং শুধু তাদের জন্য প্রয়োজন যারা বিদেশে ভ্রমণ করেন। আর জিকা ভ্যাকসিন নিয়ে সীমিত গবেষণা চলছে। কিন্তু আমাদের প্রধান ফোকাস হচ্ছে ডেঙ্গু ভ্যাকসিন নিয়ে। ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া এবং জিকা—এই তিনটি রোগই এক ধরনের মশা বা এডিশ মশার মাধ্যমে ছড়ায়। সুতরাং আমরা যদি এই মশাটিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি তবে তিনটি রোগই প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে। 

সম্প্রতিআইসিডিডিআরবির বিজ্ঞানী ড. মুহাম্মদ শফিউল আলম দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের সাথে এক আলাপচারিতায় ডেঙ্গ, চিকুনগুনিয়া ও জিকা ভ্যাকসিনের সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন। পাশাপাশি এডিশ মশা নিয়ন্ত্রণে ওলাবাচিয়া পদ্ধতি ব্যবহারেরও কথা জানিয়েছেন।

ভ্যাকসিনের ট্রায়ালসমূহ
ভ্যাকসিনের ট্রায়াল নিয়ে জিজ্ঞাসা করলে আইসিডিডিআর,বি এর বিজ্ঞানী ড. মুহাম্মদ শফিউল আলম বলেন, একটা ভ্যাকসিনের ট্রায়াল প্রক্রিয়া কয়েকটি ধাপে সম্পন্ন হয়। প্রতিটি ধাপে ভ্যাকসিনের সেফটি, কার্যকারিতা এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া পরীক্ষা করা হয়। 

প্রথমে ফেজ-০ এ পশু বা প্রাণীদের মধ্যে প্রাথমিক পরীক্ষা করা হয়। এই ধাপে ভ্যাকসিনটি কীভাবে কাজ করে এবং এটি কোনো ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে কি না তা ল্যাবরেটরিতে পর্যালোচনা করা হয়।

এরপর ফেজ-১ শুরু হয়, যেখানে মানুষের উপর পরীক্ষা করা হয়। মূলত সেফটি এবং সঠিক ডোজ নির্ধারণ করা হয় এবং এখানে দেখা হয় ভ্যাকসিনটি মানুষের শরীরে কোনো বিপজ্জনক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে কি না। 

ফেজ-২ এ পরীক্ষার পরিধি আরও বাড়ানো হয়। এখানে অনেক বেশি মানুষের উপর ভ্যাকসিনটি প্রয়োগ করা হয়। এখানে সেফটি এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা (অ্যান্টিবডি) তৈরি হচ্ছে কি না তা বিশদভাবে পরীক্ষা করা হয়। 

তারপর ফেজ-৩ এ হাজার হাজার স্বেচ্ছাসেবী অংশগ্রহণ করে। সেখানে ভ্যাকসিনটির কার্যকারিতা পরীক্ষা করা হয়। এই পর্যায়ে ভ্যাকসিনটি কতটা কার্যকরী ও রোগের বিরুদ্ধে সুরক্ষা দিতে সক্ষম কিনা তা পর্যালোচনা করা হয় এবং ফলস্বরূপ রেগুলেটরি সংস্থা এটি লাইসেন্স প্রদান করে। 

সর্বশেষ ফেজ-৪ এ বাজারে আসার পর ভ্যাকসিনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মনিটর করা হয়। এই পর্যায়ে লাখ লাখ মানুষের উপর এটি প্রয়োগ করা হয় এবং যেকোনো রেয়ার বা নতুন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া চিহ্নিত করা হয়। এর মাধ্যমে ভ্যাকসিনের নিরাপত্তা ও কার্যকারিতা নিশ্চিত করা হয় এবং জনসাধারণের জন্য এটি আরও কার্যকরী ও নিরাপদ হতে পারে।

আমাদের দেশে ট্রায়াল
ড. মুহাম্মদ শফিউল আলম বলেন, আমাদের জন্য ফেজ-৩ ট্রায়াল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এটি ভ্যাকসিনের রেগুলেটরি অ্যাপ্রুভাল পেতে সহায়তা করে। এখন পর্যন্ত আমরা দুটি ভ্যাকসিন নিয়ে কাজ করছি তাহলো টিভি ০০৩ এবং টিভি ০০৫। এনআইএইচ (National Institute of Health) ২০০২ সালে এই ভ্যাকসিনটি তৈরি করে। সাধারণত একটি ভ্যাকসিন সফলতার দিকে এগোতে ২০-২২ বছর সময় নেয়। তবে আমাদের ভ্যাকসিনটির ট্রায়াল ২০২০ সালে শুরু হয়েছে। একবার ট্রায়াল শুরু হলে তা শেষ হতে অনেক সময় নেয়। কারণ এতে ল্যাবরেটরি কাজ এবং ডাটা অ্যানালাইসিস প্রয়োজন হয়। এই ট্রায়াল শেষ হওয়ার পর আমরা পাবলিকেশন জমা দিয়েছি। যা ২০২৩ সালে জনসমক্ষে এসেছে। ওই সময়ে দেশে ডেঙ্গুর বড় আউটব্রেক ঘটেছিল। ফলে এটি আমাদের ভ্যাকসিনটির প্রতি ব্যাপক আগ্রহ সৃষ্টি করেছিল।

তিনি বলেন, আমরা যে এনআইএইচ এর ভ্যাকসিন নিয়ে কাজ করছি তার একটি ট্রায়াল ব্রাজিলে সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। এবং ইন্ডিয়াতে আরেকটি ট্রায়াল এখনো চলমান। ইন্ডিয়াতে ট্রায়ালটি যেহেতু চলমান এবং ব্রাজিলে এটি শেষ হয়েছে। ভ্যাকসিনের অনুমোদন পেতে অনেকগুলো ট্রায়াল এবং বৃহৎ মানুষের উপর এ্যাক্সপেরিম্যান্টের প্রয়োজন হয়। 

তিনি  আরও বলেন, ইন্ডিয়াতে চলমান ট্রায়ালটি  বয়স্ক লোকদের উপর ভিত্তি করে চলছে। আমরা বাংলাদেশে ফেজ-৩ ট্রায়াল চালানোর পরিকল্পনা করছিলাম। কারণ এটি সফল হলে আমাদের জন্য রিকমেন্ডেশন পাওয়ার সুযোগ তৈরি করবে। এর আগে ফেজ-২ ট্রায়াল চালিয়ে আমরা নিশ্চিত হয়েছিলাম যে এই ভ্যাকসিনটি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতায় কার্যকর। কিন্তু এখানে লোক সংখ্যা ছিল কম। তাই ফেজ-৩ এর মাধ্যমে বৃহত্তর ফলাফল আশা করা হচ্ছে।

এছাড়া তিনি বলেন, আমাদের আরেকটি ভ্যাকসিন ফেজ-২ ট্রায়ালে রয়েছে। কিন্তু এর ডাটা ফেজ-৩ এর মতো হবে। এই ট্রায়ালে মানুষের শরীরে ডেঙ্গু ভাইরাসের উইক ভাইরাস চ্যালেঞ্জ করে পরীক্ষা করা হবে। এটি হিউম্যান স্টাডি হিসেবে পরিচিত। এই স্টাডিটি এ বছর শেষ হবে এবং আমরা এখন ফান্ডিংয়ের জন্য অপেক্ষা করছি। কারণ একটি সফল ফেজ-৩ ট্রায়াল পরিচালনা করতে অনেক টাকা প্রয়োজন এবং এতে ১০-১৫ হাজার লোক দরকার। যদি প্রয়োজনীয় তহবিল পাওয়া যায় তবে আমরা শীঘ্রই ফেজ-৩ ট্রায়াল শুরু করতে পারব।

চিকুনগুনিয়া ও জিকা
ড. মুহাম্মদ শফিউল আলম বলেন, বাংলাদেশে বর্তমানে চিকুনগুনিয়া ভ্যাকসিনের ওপর কাজ করা হচ্ছে না। কারণ এই ভ্যাকসিনটি সাধারণ জনসাধারণের জন্য নয় বরং শুধু তাদের জন্য প্রয়োজন যারা বিদেশে ভ্রমণ করেন। তাই আমাদের দেশে চিকুনগুনিয়া ভ্যাকসিন আনার কোনো বিশেষ প্রয়োজনীয়তা নেই। 

তিনি আরও বলেন, তবে জিকা ভ্যাকসিন নিয়ে কিছু গবেষণা চলছে। কিন্তু জিকা ভাইরাস সম্পর্কে আমাদের জানাশোনা সীমিত। বিশেষত এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব বা আচরণ সম্পর্কে। এর ফলে আমরা এখন জিকা নিয়ে কোনো বিশেষ চিন্তা করতে চাই না। আমাদের প্রধান ফোকাস হচ্ছে ডেঙ্গু ভ্যাকসিন।

তিনি আরও বলেন, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া এবং জিকা—এই তিনটি রোগই এক ধরনের মশা বা এডিশ মশার মাধ্যমে ছড়ায়। যদি আমরা এই মশাটিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি তবে তিনটি রোগই প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে। তবে একে একে প্রতিটি রোগের জন্য আলাদা ভ্যাকসিন তৈরি করার পরিবর্তে আমরা যদি শুধু মশা নিয়ন্ত্রণ করতে ফোকাস করি তাহলে অনেক বেশি কার্যকর এবং সহজ হবে। বর্তমানে আমাদের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত মশা নিয়ন্ত্রণে জোর দেওয়া। ফলে সব ধরনের রোগ প্রতিরোধে সহায়ক হবে।

মশা নিয়ন্ত্রণ
ড. মুহাম্মদ শফিউল আলম বলেন, আমাদের দেশে  মশা নিয়ন্ত্রণের জন্য কাজ চলছে। বিভিন্ন কেমিক্যাল মিশ্রন করে মশা নিধনের জন্য যে ব্যবস্থা করা হয় তার ফলাফল খারাপ। আমাদের পরিবেশে অনেক উপকারী পোকামাকড় আছে ফলে এই কেমিক্যাল ব্যবহার করার কারণে তারাও মারা যায়। এর ফলে সামগ্রিক যে ইকোসিস্টেম আছে তার উপর বাস্তব প্রভাব ফেলে।

তিনি আরও বলেন, মশা নিয়ন্ত্রণ জন্য আমাদের নতুন নতুন পদ্ধতিতে যেতে হবে। যাতে কেমিক্যাল কম ব্যবহার করে মশাকে দমন করা যায়। বিকল্প হিসেবে পিটিআই, ওলবাচিয়া হতে পারে। ওলবাচিয়া হলো একটা ব্যাকটেরিয়া (ইন্দোনেশিয়া দেখা যায়) এটা যখন তার মধ্যে থাকবে তখন মশার ভিতর একটা উইকন্যাস কাজ করবে। এটাকে আর্টেফিশিয়ালে মশার ভিতর ঢুকানো হয়। তখন এর ভিতরে ভাইরাস গ্রো করতে পারেনা। এটি এক মশা থেকে অন্য মশায় বা প্রজন্মে যায় ডিমের মাধ্যমে। একটা ওলবাচিয়া ম্যাল মশা যখন কোন ওয়াইট মশা মিট করে তখন তার ডিম ফারটাইল হয়না। কিন্তু যদি ওলবাচিয়া একটা ফিমেল মশা যতি একটা ম্যাল মশার সাথে মিট করে তখন যে বাচ্চাগুলা হয় তখন সবগুলোর মধ্যে ওলবাচিয়া চলে যায়। 

তিনি বলেন, হোয়াইট এডিশ মশাকে ওলবাচিয়াতে রিপ্লেস করছে ইন্দোনেশিয়ায়। যার কারণে ডেঙ্গুটা কমে যায়। এই ধরনের জিনিসগুলো বাংলাদেশে করা যেতে পারে। এইটা নিয়ে আমাদের কাজ হচ্ছে। ২০১৮ এত আমরা এইটা নিয়ে মন্ত্রণালয়ে গিয়েছি। যারা ইন্দোনেশিয়ায় এই কাজটা করেছে তাদের ইন্টারেস্ট আছে বাংলাদেশে কাজটা করার জন্য। আমরা যেটা করেছি বাংলাদেশি মশার মধ্যে আমরা ওলবাচিয়া ঢুকিয়েছি। এবং এইগুলো নিয়ে আমরা ল্যাবে কাজ করে দেখেছি যে এটা কাজ করে। 

কিন্তু আমাদের পরিকল্পনা আছে আমাদের আইসিডিডিআর বি তে এটি নিয়ে কাজ করা। যদি আমরা বাংলাদেশে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করতে চাই। আমাদের ভ্যাকসিনও লাগবে আবার ওলবাচিয়াও লাগবে। এই দুইটা তে আমরা কাজ করছি। 

তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে বর্তমানে মশা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে কাজ চলছে। তবে কেমিক্যাল মিশ্রণ ব্যবহার করে মশা নিধনের যে ব্যবস্থা রয়েছে তার ফলাফল খুবই সীমিত। আমাদের পরিবেশে অনেক উপকারী পোকামাকড় রয়েছে এবং এই কেমিকেল ব্যবহারের ফলে তারাও মারা যাচ্ছে। এটি আমাদের ইকোসিস্টেম এর ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এজন্য মশা নিয়ন্ত্রণের জন্য নতুন এবং কার্যকর পদ্ধতিতে যেতে হবে। যাতে কেমিক্যাল ব্যবহারের পরিমাণ কমানো যায়। 

তিনি বলেন, একটি বিকল্প পদ্ধতি হিসেবে পিটিআইএ (PTIA) এবং ওলবাচিয়া নামক ব্যাকটেরিয়া ব্যবহারের কথা ভাবা হচ্ছে। ওলবাচিয়া একটি ব্যাকটেরিয়া। এটি ইন্দোনেশিয়া সহ অন্যান্য দেশে মশা নিয়ন্ত্রণে কার্যকরভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এই ব্যাকটেরিয়া যখন মশার মধ্যে প্রবেশ করে তখন মশার ভিতরে একটি উইকনেস কাজ করতে থাকেন। ফলে ভাইরাসটি মশার শরীরে বৃদ্ধি পায় না। ওলবাচিয়া মশার ডিমের মাধ্যমে এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে ছড়িয়ে পড়ে।

তিনি আরও বলেন, বিশেষভাবে যখন ওলবাচিয়া ব্যাকটেরিয়া একটি হোয়াইট এডিশ মশা (মহিলা) এর মধ্যে প্রবেশ করে তখন ম্যাল মশা (পুরুষ) এর সাথে মিলিত হলে তার ডিম ফারটাইল হয় না। কিন্তু যদি ওলবাচিয়া একটি মহিলা মশা এর মধ্যে থাকে এবং সে একটি পুরুষ মশার সাথে মিলিত হয় তবে তার সমস্ত ডিমের মধ্যে ওলবাচিয়া চলে আসে। ফলে ডেঙ্গুর ভাইরাসের বিস্তার বন্ধ হয়ে যায়।

ইন্দোনেশিয়ায় এই পদ্ধতিটি কার্যকরভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে। সেখানে হোয়াইট এডিশ মশাকে ওলবাচিয়া ব্যাকটেরিয়ায় রিপ্লেস করা হচ্ছে। ফলে ডেঙ্গু রোগের প্রাদুর্ভাব কমে গেছে। এই প্রযুক্তি বাংলাদেশেও প্রয়োগ করা সম্ভব এবং আমরা এই পদ্ধতি নিয়ে কাজ করছি। ২০১৮ সালে আমরা এই প্রকল্পটি নিয়ে মন্ত্রণালয়ে গিয়েছিলাম এবং ইন্দোনেশিয়াতে যারা এই কাজটি করেছে তারা এই কাজটি বাংলাদেশে করার জন্য তাদের আগ্রহ রয়েছে-তিনি যোগ করেন। 

তিনি বলেন, এছাড়া বাংলাদেশি মশার মধ্যে আমরা ওলবাচিয়া ঢুকিয়েছি এবং ল্যাব পরীক্ষায় দেখেছি যে এটি কার্যকর। তবে এটি এখনও পুরোপুরি বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রয়োগ করা হয়নি। কিন্তু আমাদের পরিকল্পনা রয়েছে আইসিডিডিআরবি-তে এটি বাস্তবায়ন করার।

তিনি বলেন, বাংলাদেশে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করতে আমাদের দুটি মূল পদ্ধতিতে কাজ করতে হবে—ভ্যাকসিন এবং ওলবাচিয়া। এই দুটি পদ্ধতির সমন্বয়ে, ডেঙ্গু ভাইরাসের বিস্তার রোধ করা সম্ভব হবে। পাশাপাশি, জনসচেতনতার মাধ্যমে মানুষকে সচেতন করে তোলা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

ফান্ডিংয়ের ব্যবস্থা
ড. মুহাম্মদ শফিউল আলম আরও বলেন, আমরা যেকাজগুলো পরিচালনা করি তার জন্য ফান্ডিং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ফান্ডিং পেতে আমাদের বিভিন্ন উৎস থেকে সহায়তা নিতে হয়। সাধারণত যখন আমাদের ইন্টারনাল ফান্ডিং কম থাকে তখন আমরা দুইটি প্রধান উৎস থেকে বেশি ফান্ডিং অর্জন করি: একটি লোকাল এবং অন্যটি ইন্টারন্যাশনাল।

তিনি বলেন, লোকাল ফান্ডিং আমরা মূলত দুইটি প্রধান উৎস থেকে পাই। প্রথমত সরকারের ডিজি হেলথ (Director General of Health) এর মাধ্যমে। সরকার বিভিন্ন স্বাস্থ্য প্রকল্প এবং উদ্যোগে অর্থনৈতিক সহায়তা প্রদান করে।  এটি আমাদের দেশের অভ্যন্তরীণ স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও গবেষণার কাজকে এগিয়ে নিতে সহায়ক। দ্বিতীয়ত আমরা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) থেকে ফান্ডিং পাই। WHO আন্তর্জাতিক পরিসরে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত প্রকল্পগুলির জন্য সহায়তা প্রদান করে। এর মাধ্যমে আমাদের স্থানীয় প্রকল্পগুলির কার্যকারিতা এবং বিশ্বমানের গবেষণা কার্যক্রম আরও শক্তিশালী হয়।

অন্যদিকে ইন্টারন্যাশনাল ফান্ডিংও আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান থেকে সহায়তা লাভ করি। এই ফান্ডিং সাধারণত বিভিন্ন দেশের বা আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কাছ থেকে আসে। যারা আমাদের প্রকল্পের জন্য সহায়তা করতে আগ্রহী থাকে। 

আন্তর্জাতিক ফান্ডিং আমাদের কাজকে বিশ্বব্যাপী প্রসারিত করতে সহায়তা করে এবং স্বাস্থ্য সেবা ও গবেষণার ক্ষেত্রে আমাদের কর্মের মান উন্নত করে।

তিনি আরও বলেন, এছাড়া আমাদের ফান্ডিংয়ের আরেকটি বড় উৎস হলো কম্পিটিশন। বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে আমরা আর্থিক সহায়তা অর্জন করি। এই কম্পিটিশনগুলি বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান কোম্পানি বা সংস্থার মাধ্যমে পরিচালিত হয়। যারা আমাদের প্রকল্পে সহায়তা প্রদান করতে আগ্রহী। এসব কম্পিটিশনের মাধ্যমে আমরা নতুন আইডিয়া এবং উদ্ভাবনগুলোর জন্য ফান্ডিং জোগাড় করতে পারি।

সুতরাং আমাদের ফান্ডিং সংগ্রহের জন্য তিনটি প্রধান উৎস—লোকাল ফান্ডিং, ইন্টারন্যাশনাল ফান্ডিং এবং কম্পিটিশন—এই তিনটি মাধ্যম একত্রে আমাদের কাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এগুলোর সাহায্যে আমরা আমাদের গবেষণা এবং প্রকল্পগুলো সফলভাবে বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হই।

জনসচেতনতা
ড. মুহাম্মদ শফিউল আলম উল্লেখ করেন, জনসচেতনতা সৃষ্টির খুবই গুরুত্ব রয়েছে। বিশেষ করে যেখানে মশা ডিম পাড়ে। যদি আমরা এসব জায়গায় মশার ডিম ধ্বংস করতে পারি তবে ডিম পাড়ার প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাবে।ফলে মশার প্রজনন রোধ হবে। শুধু বাড়িঘরই নয় বরং এমন জায়গাগুলিতেও যেখানে নির্মাণকাজ চলছে বা বড় বড় ফ্লাইওভার রয়েছে সেখানে মশা ডিম পাড়তে পারে। সুতরাং এসব জায়গায় নজরদারি বাড়াতে হবে। এছাড়া আমরা বিভিন্ন ধরনের কনটেইনার ব্যবহার করি যেমন প্লাস্টিকের কাপ, গ্লাস, ইত্যাদি যেখানে বৃষ্টির পানি জমে মশা ডিম পাড়তে পারে। এর ফলে, ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়।

তিনি আরও বলেন, মশা নিধনের কাজ শুধু সিটি করপোরেশন দ্বারা করা সম্ভব নয়। কারণ ঢাকার শহরে প্রায় দেড় থেকে দুই কোটি মানুষ বাস করে এবং এই পরিমাণ জনগণের জন্য প্রয়োজনীয় বাজেট জোগানো কঠিন। যদিও সিটি করপোরেশন ঢাকার শহরের মধ্যে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। তবে শহরের বাইরের এলাকাগুলোতে একইভাবে মশা নিধন কার্যক্রম চালানো কঠিন। সুতরাং বাইরের এলাকাতেও মশা নিয়ন্ত্রণে গুরুত্ব দিতে হবে।

তিনি আরও বলেন, বর্তমানে আমরা ফেজ-২ ট্রায়াল নিয়ে কাজ করছি এবং এই প্রক্রিয়ার পাশাপাশি আমরা ডায়াগনোসিস নিয়ে কাজ করছি। ২০২৩ সালে আমাদের দেশে জিকা ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটেছে এবং তার সাথে দেখা গেছে যে চিকুনগুনিয়াও দ্রুত ছড়াচ্ছে। আমাদের ধারণা, এই বছর চিকুনগুনিয়া একটি বড় আউটব্রেক হতে পারে এবং ডেঙ্গুও এর সাথে থাকবে। তবে জিকা ভাইরাস হয়তো ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার তুলনায় কম গুরুত্ব পাবে। যতদিন না আমরা ভ্যাকসিনে সফল হচ্ছি। এইজন্য আমাদের ভেক্টর কন্ট্রোল বা মশা নিয়ন্ত্রণের দিকে আরও বেশি মনোযোগ দিতে হবে।

তিনি বলেন, ভ্যাকসিন আসলে একটি ডেভেলপমেন্ট প্রক্রিয়া। এটি কোনো ধরনের ইনভেনশন নয়। ভ্যাকসিনের প্রতিটি কম্পোনেন্ট আলাদাভাবে পরীক্ষা করা হয়। বিভিন্ন দেশ যেমন বাংলাদেশ, আমেরিকা, থাইল্যান্ড, ব্রাজিলসহ  বিভিন্ন দেশে ভ্যাকসিন পরীক্ষা করা হয়; তখন এটি কার্যকরী হয়ে ওঠে।

তিনি আরও উল্লেখ করেন, আমরা গ্লোবাল স্টেজে এই কাজগুলো করি কারণ একটি ভ্যাকসিন সফল হতে হলে তা পৃথিবীজুড়ে বিভিন্ন দেশে পরীক্ষা করা প্রয়োজন। যদি আমরা ফেজ-৩ বা ফেজ-২ ট্রায়ালগুলোতে সফল হতে পারি এবং পরীক্ষামূলক কার্যক্রমগুলো কার্যকরী হয় তাহলে গ্লোবালি সেই ভ্যাকসিনটি ডোজ হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। এতে আমরা গ্লোবাল ভ্যাকসিন কার্যক্রমে কন্ট্রিবিউটরদের মধ্যে একজন হিসেবে পরিচিত হতে পারি।

ভ্যাকসিনের পেছনের দুর্বলতা
ড. মুহাম্মদ শফিউল আলম বলেন, ভ্যাকসিন উন্নয়নে প্রধান দুর্বলতা হলো ইনভেস্টমেন্টের অভাব। কোনো বৈজ্ঞানিক উন্নয়ন বা প্রযুক্তি আবিষ্কারের জন্য প্রচুর সময়, পরিশ্রম এবং বিনিয়োগ প্রয়োজন। এটি রাতারাতি অর্জিত হতে পারে না। আমাদের দেশে রিসোর্সের অভাব এবং টাকা-পয়সার সংকট থাকার কারণে এই ধরনের বড় প্রকল্পগুলো সম্পন্ন করা কঠিন হয়ে পড়ে। অন্যদিকে ইউরোপ এবং আমেরিকা মতো উন্নত দেশগুলো এই ক্ষেত্রে অনেক বেশি বিনিয়োগ করে। ফলে শুধু তাদের বিজ্ঞানের উন্নতির জন্য নয় বরং এক ধরনের ব্যবসায়িক লাভও সৃষ্টি করে। উদাহরণস্বরূপ এ্যাস্ট্রাজেনেকা এবং অন্য কিছু কোম্পানি যে ভ্যাকসিন তৈরি করেছে তাদের দ্বারা আয় করা মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার সেসব দেশের রেভেনিউতে যোগ হয়েছে।

তিনি বলেন, আমাদের দেশের প্রধান সমস্যা হলো বেসিক নিড খুব বেশি। আর সেই কারণে আমরা কিছু ক্ষেত্রেই পিছিয়ে আছি। আমাদের দেশে বিনিয়োগের অভাব এবং প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর ঘাটতি রয়েছে।  ফলে আমরা বৈজ্ঞানিক গবেষণার ক্ষেত্রে অনেকটা বাধাগ্রস্ত হচ্ছি। তিনি স্পষ্টভাবে বলেন, এই পরিস্থিতিতে সরকারকে দোষ দেওয়া সঠিক হবে না। তবে তিনি জোর দিয়ে বলেন, ইনভেস্টমেন্টের অভাব আমাদের প্রধান সমস্যার কারণ। 

অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতার কারণে, অনেক বিজ্ঞানী এবং গবেষক বিদেশে চলে যাচ্ছেন। এটিকে আমরা ব্রেইন ড্রেইন হিসেবে অভিহিত করি। তিনি আরও বলেন, আমার অনেক পরিচিত বিজ্ঞানী আছেন যারা আর দেশে ফিরে আসেন না, কারণ দেশে তাদের কাজ করার সুযোগ এবং পর্যাপ্ত অবকাঠামো নেই।

তিনি আরও উল্লেখ করেন, আমাদের দেশের বিসিএসআইআর (বাংলাদেশ কাউন্সিল ফর সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ)-এ কিছু ক্ষেত্রে প্রশাসনিক সমস্যা এবং অপারেশনাল অব্যবস্থাপনা রয়েছে। ফলে গবেষকদের জন্য প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। অনেকসময় আমলারা গবেষণা তহবিল এবং স্কলারশিপের যথাযথ ব্যবহার না করে নিজেরাই তা ভাগ করে নেন। যার ফলে প্রকৃত গবেষকদের জন্য সুযোগ সংকুচিত হয়। এসব সমস্যার কারণে গবেষকদের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি হয়। এবং অনেকে দেশের বাইরে চলে যান।


সর্বশেষ সংবাদ