‘সরকার প্রচুর কমিশন গঠন করেছে, কিন্তু শিক্ষা কমিশন করেনি’
- টিডিসি রিপোর্ট
- প্রকাশ: ১৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৬:২৭ PM , আপডেট: ১৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৬:২৭ PM

বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অনেকগুলো কমিশন গঠন করলেও শিক্ষা সংস্কারের বিষয়ে তেমন কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। রাষ্ট্র সংস্কারের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে শিক্ষা সংস্কার কমিশন গঠন করা অত্যন্ত জরুরি বলে মন্তব্য করেছেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম।
মঙ্গলবার (১৭ ডিসেম্বর) দুপুরে রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গনে একাডেমিক অধিকার লঙ্ঘন: প্রতিকারের নীতি সুপারিশ’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় অংশ নিয়ে তিনি এসব কথা বলেন। কাউন্সিল ফর দ্য রাইটস অব একাডেমিয়া নামে একটি সংগঠন এ সভার আয়োজন করে।
এসময় বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা সংস্কারে কমিশন গঠন করা সহ ১২টি সুপারিশ পেশ করেছে কাউন্সিল ফর দ্যা রাইটস অব একাডেমিয়া।
সংগঠনটির ১২ দফা সুপারিশের মধ্যে আছে শিক্ষা সংস্কার কমিশন গঠন, শিক্ষাক্রম প্রণয়ন ও পাঠ্যপুস্তক পরিমার্জন, মূল্যায়ন পদ্ধতির সংস্কার, শিক্ষা বাজেটে জিডিপির ৬ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা, গবেষণামুখী উচ্চশিক্ষা গড়ে তোলা, শিক্ষাব্যবস্থার প্রতিটি স্তরে স্বতন্ত্র শিক্ষক নিয়োগ কমিশন গঠন, মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার, কারিগরি শিক্ষার মান বৃদ্ধি, শিক্ষার ডিজিটাল রূপান্তর, মানসিক স্বাস্থ্যসেবা ও কাউন্সেলিং ব্যবস্থা, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের জন্য অন্তভুর্ক্তিমূলক শিক্ষা নিশ্চিতকরণ এবং বুলিং ও র্যাগিং বন্ধে পদক্ষেপ গ্রহণ।
এসময় প্রধান আলোচকের বক্তব্যে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম বলেন, আমাদের সরকার প্রচুর কমিশন করেছে। কিন্তু শিক্ষা সংস্কারের গবেষণা নিয়ে কোন কথা বলছে না। রাষ্ট্র সংস্কারের প্রথম কমিশন হওয়া উচিত শিক্ষা সংস্কার কমিশন। শিক্ষা কমিশন গঠন এখন সবচেয়ে জরুরি। আমাদের দেশে বিভিন্ন সময় কমিশন হয়েছে।
‘সেসব কমিশন যেসব প্রস্তাব দিয়েছে, সেসব খুবই দীর্ঘমেয়াদি। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আসলে ক্যাপাবিলিটি নাই। যেখানে জিডিপির ৬ শতাংশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ দেয়া উচিত, সেখানে ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যান্য দেশে ৪ শতাংশ আছে। বাংলাদেশে এতদিন ছিল ২.১ শতাংশ, এখন তা মাত্র ১.৬০ শতাংশ। শুধুমাত্র নৈতিকতার কারণে একজন ভাল শিক্ষক হবেন এমনটা সম্ভব নয়। প্রাইমারি স্কুলে মাত্র ১৭ হাজার টাকায় ভাল শিক্ষক পাওয়া সম্ভব নয়।’
ইংরেজি ভাষা শিক্ষার পরিধি বাড়ানোর উপর গুরুত্ব দিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশের লোকেরা ইংরেজি জানে না— এটা নিশ্চিত। ইংরেজি ভাষাভাষী লোকের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ৮২ তম। অথচ ভদ্রলোকের ছেলে মেয়ে ইংরেজি মিডিয়াম ছাড়া পড়ে না। এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন আরবান টপার মিডল ক্লাসের ছেলেমেয়েরা পড়ে না। এতগুলো লোক যদি ইংরেজিতে পড়ে তাহলে ইংরেজি ভাষাভাষী কম কেন?
অধ্যাপক আজম আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, ৫ বছরে এ পরিস্থিতির পরিবর্তন করা সম্ভব। গতবারের যে কারিকুলামের সেটা আইডিয়ালি ভাল, তবে বাস্তবায়নযোগ্য নয়। পাঠ্যপুস্তকের ভূমিকায় তারা বিশ^ব্যাংকের কথা লিখেছে, সরাসরি স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলো থেকে ইংরেজি থেকে অনুবাদ করে নির্লজ্জের মত লিখে দিয়েছে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গণগত পরিবর্তনের প্রত্যাশা ব্যক্ত করে তিনি বলেন, আমরা ভার্সিটিতে শুধুমাত্র একটা পরিবর্তন চাই। স্টুডেন্ট না হলে কেউ হলে থাকতে পারবে না। ৫৩ বছরে প্রথমবারের মত এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। আরেকটা নিয়ম হবে, নভেম্বর মাসে একাডেমিক ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ইলেকশন দিতে হবে। সেকেন্ড মাস্টার্স বা এমফিল কেউ ভোট দিতে পারবেন না। নির্দিষ্ট সময় পর এটার ফল হবে অসাধারণ।
বিশেষ আলোচনায় লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল এন্ড আফ্রিকান স্টাডিজের অর্থনীতির অধ্যাপক ড. মুশতাক খান বলেন, কেউ কোন জাতিকে ধ্বংস করতে চাইলে তার শিক্ষা ব্যবস্থা নষ্ট করতে হবে। শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কারের উপর থেকে যেমন চাপ আসতে হবে তেমনি নিচের থেকেও চাপ আসতে হবে। বর্তমান সরকার বেশিদিন থাকবে না। উন্নয়ন বলতে অল্প খরচে অদক্ষ শ্রমিক দিয়ে রপ্তানি করে রেমিটেন্স আনলেই হবে না।
তিনি আরও বলেন, আমাদের পোশাক শিল্পে বাইরের দেশের অনেক লোক কাজ করে ইংরেজি জানার কারণে। বাংলাদেশের ছেলে মেয়েরা সাংঘাতিক মেধাবী। সস্তা শ্রমের অদক্ষ শ্রমিকের যুগ শেষ। এখন গবেষণার যুগ। আমাদের শিক্ষাঙ্গনে জবাবদিহিতা ও উৎকৃষ্ট মানের গবেষণা নিশ্চিত করতে হবে। রাষ্ট্রব্যবস্থা, শিক্ষাব্যবস্থার সাথে ছাত্র—শিক্ষক সবকিছুর সাথে গুড গভন্যার্ন্সের অধীনে নিয়ে আসতে পারলে এর সুফল পাওয়া যাবে।
স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের সদস্য ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ তারিকুল ইসলাম বলেন, ভার্সিটিতে মাল্টি লেভেল গভর্ন্যান্স অ্যাপ্রোচ খুব দরকার। পলিটিক্যাল লক্ষ্য না থাকলে এত পরিকল্পনার কোনোটাই কাজ করবে না। আমাদের হায়ার এডুকেশনে ভিসিই সব, সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। এখানে বিকেন্দ্রীকরণ খুব দরকার।
তিনি আরও বলেন, উন্নত দেশগুলোতে অফিস অব এক্সিলেন্স হন ডীন। কিন্তু বাংলাদেশে অনেক ক্ষেত্রে নিয়োগ বোর্ডেও ডীন থাকেন না। আমাদের দেশে ৫৬ টা পাবলিক ও ১১২ টা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় আছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে রিওয়ার্ডের বিপরীতে থাকবে পেনাল্টি। ভাল কাজের যেমন পুরস্কার আছে, তেমনি পেনাল্টিও থাকতে হবে। ৫ আগস্টের পর প্রচুর সেমিনার হচ্ছে। এটা নিয়ে আমাদের কাজ করতে হবে। প্রত্যেকটা ক্লাসে বিদেশি শিক্ষার্থী থাকতে হবে। এখন আর পেছনে ফিরে তাকানোর সুযোগ নাই। গ্লোবাল কানেকটিভিটি বৃদ্ধিসহ গভন্যার্ন্স ও পলিটিক্যাল অ্যাপ্রোচ সব একসাথে কাজে লাগাতে হবে।
এডুকেশন রিপোর্টার্স এসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি মীর মোহাম্মদ জসিম বলেন, শিক্ষা ক্ষেত্রে সত্যিকারের পরিবর্তন করতে হলে পলিটিকাল কমিটমেন্ট লাগবে। বিশ্ববিদ্যালয় বলতে যা বোঝায় বাংলাদেশে তার একটাও নাই। শুধু বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বাংলাদেশে ১ হাজার গবেষণা হয়েছে, সেটা দেখিয়ে অনেকে অধ্যাপক হয়েছে। বাংলাদেশে যে কয়টা থিসিস হয়, তার মান-স্ট্রাকচার ঠিক করতে হবে। আমরা শিক্ষাঙ্গনে আর পলিটিকাল প্রভাব দেখতে চাই না।
অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য রাখেন কাউন্সিল ফর দ্য রাইটস অব একাডেমিয়ার আহ্বায়ক বেলাল হোসেন, মুখপাত্র প্লাবন তারিক, সদস্য সচিব আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ, জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য জয়নাল আবেদিন শিশির, উত্তরা ইউনিভার্সিটির খণ্ডকালীন শিক্ষক মাহবুব আলম, ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ইউসুফ আলি প্রমুখ।