শাকসু ২৭ বছর অচল, নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছেন ছাত্রসংগঠনের নেতারা

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (শাবিপ্রবি)
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (শাবিপ্রবি)  © ফাইল ফটো

শিক্ষাঙ্গনে নেতৃত্বের বিকাশ, গণতন্ত্রের চর্চা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও শিক্ষার্থীদের অধিকার নিশ্চিত করার একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম নির্বাচিত ছাত্র সংসদ। প্রতিষ্ঠার পর কয়েকবার নির্বাচন হলেও দীর্ঘ ২৭ বছর ধরে অচল হয়ে আছে  শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (শাকসু)। ফলে শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবি আদায়ে নেই কোনো কার্যকরী মাধ্যম। 

দীর্ঘ ১৫ বছরের আওয়ামী শাসনামলে ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়ে ক্ষমতাসীনদের মাঝে ছিল সদিচ্ছার অভাব। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের গুরুত্ব ফুটে উঠেছে শিক্ষার্থীদের মাঝে। সুস্থ ধারার গণতান্ত্রিক পরিবেশে রাজনৈতিক চর্চা, সুদৃঢ়, যোগ্য ও মেধাবী নেতৃত্ব গড়ে তোলার জন্য ছাত্র সংসদ নির্বাচন জরুরি বলে মনে করছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। ছাত্র সংসদ অকার্যকর থাকার ফলে ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবি উত্থাপনে আনুষ্ঠানিক কোনো প্রতিনিধি না থাকায় অনেক জটিলতা সৃষ্টি হয় বলে মনে করছেন শিক্ষার্থীরা। কবে এবং কখন ছাত্র সংসদ নির্বাচন হবে তার স্পষ্ট কোনো রূপরেখা আসেনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচন হওয়ার পর শাকসু নির্বাচন দেবেন বলে জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এম সরওয়ারউদ্দিন চৌধুরী।  

যেমন ছিল শাকসুর পথচলা
প্রতিষ্ঠার পর থেকে সর্বমোট পাঁচবার শাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ১৯৯১ সালে তিনটি বিভাগ নিয়ে যাত্রা শুরু করে শাবি। তিনটি বিভাগের ক্লাস প্রতিনিধিদের মনোনীত করার মধ্য দিয়ে শাকসু যাত্রা শুরু করে। পরের বছর শিক্ষার্থীদের প্রত্যক্ষ ভোটে শাকসুর প্রথম সাধারণ সম্পাদক (জিএস) হিসেবে নির্বাচিত হন অর্থনীতি বিভাগের প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী হারুন উর রশিদ। তবে এ সংসদের কোনও ভিপি ছিল না। ১৯৯৩ সালে দ্বিতীয়বার নির্বাচনে একইসঙ্গে সহ-সভাপতি (ভিপি) ও সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পান শাবি শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের ভোটে ভিপি হন নির্বাচিত আব্দুস সালাম ও জিএস হন সাব্বির আহমেদ। এরপর ১৯৯৪ সালের ২৩ জুনের নির্বাচনে ভিপি হন দেলোয়ার ইসমাইল টিটু ও জিএস হন কামরুল ইসলাম। পরে ১৯৯৫ সালে আশরাফুল আলম রুবন ভিপি ও বদরুজ্জোহা শাহিন জিএস পদে জয় পান।  

১৯৯৬ সালে পঞ্চম নির্বাচন নিয়ে ঝামেলা হওয়ায় তা আর অনুষ্ঠিত হয়নি। তবে ১৯৯৭ সালের ২৫ আগস্ট সর্বশেষ শাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে ভিপি হিসেবে কামরুল আহমেদ কাবেরী ও জিএস পদে আব্দুল্লাহ আল মামুন জয় পান। নির্বাচনে ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেল ১৯টি পদের মধ্যে ১৭টিতে জয় পায়। এরপর আর গত ২২ বছরে শাকসুর কোনও নির্বাচন হয়নি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিগত সময়ের সরকার ও সরকারি দলের ছাত্রসংগঠনগুলোর অনিহার কারণেই শাকসু সচল হয়নি। নিজেদের আধিপত্য খর্ব হওয়ার ভয়ে নির্বাচন চায়নি ছাত্র সংগঠনগুলো।

ছাত্রসংগঠনের ভাবনা
ছাত্র সংসদ নিয়ে দেশের প্রধান দুটি বড় ছাত্র সংগঠন, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ও বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরে মধ্যেও রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। শিবিরের নেতাকর্মীরা দ্রুত শাকসু নির্বাচন চাইলেও কিছুদিন বিলম্বে চায় ছাত্রদল। বর্তমান অন্তবর্তীকালীন সরকারের সময়ে নিরপেক্ষ ও শৃঙ্খল পরিবেশে নিয়মতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ নির্বাচন সম্ভব বলে মনে করছে ছাত্রশিবির। তবে নির্বাচনের আগে ক্যাম্পাসে রাজনৈতিক অধিকার ও সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার স্বাধীনতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে তারপর নির্বাচন চান ছাত্রদল। 

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের শাবিপ্রবি শাখা সভাপতি রাহাত জামান বলেন, ‘আমরা ছাত্র সংসদ (শাকসু) নির্বাচনের প্রতি নীতিগতভাবে পূর্ণাঙ্গ সমর্থন করি। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, একটি প্রকৃত অর্থে গণতান্ত্রিক, অংশগ্রহণমূলক এবং স্বচ্ছ ছাত্র সংসদই পারে ছাত্রসমাজের স্বার্থ সংরক্ষণ, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠার মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করতে। তবে একটি কার্যকর ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনী প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে হলে অবশ্যই নিরপেক্ষতা, সমতা ও রাজনৈতিক পরিসরের স্বাধীনতা নিশ্চিতকারী কিছু অপরিহার্য পূর্বশর্ত পূরণ করতে হবে। অন্যথায় এই নির্বাচন হবে একপ্রকার নিয়ন্ত্রিত আনুষ্ঠানিকতা যা গণতন্ত্রের প্রকৃত চর্চা নয়।’

তিনি আরও বলেন, শাকসু নির্বাচনের আগে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মুক্ত রাজনীতি চর্চা এবং সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার পূর্ণাঙ্গ অধিকার নিশ্চিত করা। এছাড়াও, প্রশাসনের মধ্যে বিদ্যমান সিস্টেমেটিক বায়াসের অবসান ঘটিয়ে ছাত্রসমাজের প্রতি সমান আচরণ ও ন্যায্যতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন বলেও মনে করেন তিনি।

বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের শাবিপ্রবি শাখা সভাপতি তারেক মনোয়ার বলেন, ‘ছাত্র সংসদ নির্বাচন হলো গণতান্ত্রিক চর্চার একটি  বীজতলা। এখানে শুধুমাত্র পাঠ্যপুস্তকীয় জ্ঞান নয়, গড়ে ওঠে একটি প্রজন্মের মূল্যবোধ, নৈতিকতা ও নেতৃত্বের গুণাবলি। আর সেই গুণাবলির পরিপূর্ণ বিকাশে ছাত্র সংসদ নির্বাচন এক অপরিহার্য অনুষঙ্গ।’

তিনি আরও বলেন, ‘বিগত সময়ে ক্ষমতাসীন দলের ছত্রছায়ায় ছাত্রসংগঠনগুলো ক্ষমতা কুক্ষিগত করে শিক্ষার্থীদের অধিকার হরণ করেছে। হাজারো শিক্ষার্থীর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত দ্বিতীয় স্বাধীনতাকে প্রকৃত অর্থেই শিক্ষার্থীদের অধিকার কাজে লাগাতে হলে ছাত্র প্রতিনিধি আবশ্যিক। তবে দুঃখজনক ব্যাপার হলো ২৭ বছর ধরে শাবিপ্রবিতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন বন্ধ রয়েছে। এর পেছনে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, সহিংসতা কিংবা প্রশাসনিক নিষ্ক্রিয়তা দায়ী হলেও প্রকৃত ক্ষতি হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। যেহেতু ফ্যাসিস্ট হাসিনা পতনের মধ্যে দিয়ে ক্যাম্পাসে একটি মুক্ত গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি হয়েছে। সেহেতু  বাধা ও অনিয়ম দূর করে নিয়মতান্ত্রিক, অংশগ্রহণমূলক ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।’


সর্বশেষ সংবাদ