সেনাবাহিনীতে চাকরির স্বপ্ন অধরাই রয়ে গেল আন্দোলনে চোখ হারানো নূরের
যারা আমাদের প্রিয় বাংলাদেশকে স্বৈরাচারমুক্ত একটি স্বাধীন দেশ উপহার দিয়েছেন। কিন্তু স্বাধীনতার এই আলোকিত পথ সব সময় মসৃণ ছিল না। এই স্বাধীনতার পথে কতজনের স্বপ্ন, জীবন, এমনকি অঙ্গ হারিয়ে গেছে—সেই গল্পগুলো প্রায়শই অজানা থেকে যায়। এ দেশকে স্বৈরাচারমুক্ত করতে মত প্রকাশের যে আন্দোলন হয়েছে, তাতে অংশগ্রহণকারী অসংখ্য যোদ্ধার ত্যাগ রয়েছে। আজ আমরা জানবো এমন এক সাহসী যোদ্ধার কথা, যিনি নিজের ডান চোখ হারিয়েও স্বপ্ন দেখেন দেশের জন্য আত্মত্যাগের। তিনি মো. নূর হোসেন।
নূর হোসেন পড়াশোনা করছেন বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএসএস ডিগ্রি প্রোগ্রামে। ছোটবেলা থেকেই তার ইচ্ছা ছিল বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে দেশের সেবা করা। তার মন সবসময় স্বপ্নের পোশাকের জন্য আকুল, দেশের প্রতি গভীর প্রেমে রাঙানো। তার মন থাকত সেনাবাহিনীর জলপাই পোশাকের জন্য মন্ত্রমুগ্ধ। কিন্তু সেই স্বপ্ন ভেঙে যায় স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের এক নির্মম দিনে। আজ তিনি এক চোখ হারিয়েও জীবনের আলো খুঁজছেন দেশমাতৃকার ভালোবাসায়।
স্বপ্নের পোশাকের জন্য আজও আকুলতা
নূরের নিজের কথায়, “আমি যখন সিএমএইচে ট্রিটমেন্ট নিচ্ছিলাম, তখন সেনাবাহিনীর সেই জলপাই রঙের পোশাকগুলো দেখতাম। মনে হতো, যদি একদিনের জন্যও সেই পোশাকটা গায়ে দিতে পারতাম, তাহলে জীবনটা সফল মনে হতো।” কিন্তু আজ সেই পোশাক ছোঁয়ার বদলে তার জীবনে নেমে এসেছে অন্ধকার। চোখ হারিয়ে যে যন্ত্রণা তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়, তার থেকেও বড় কষ্ট হলো তার স্বপ্নের কী হবে। তবুও, তাঁর মনের মধ্যে অমলিন স্বপ্নের পোশাক এখনও ঘুরে বেড়ায়। সে আজও স্বপ্ন দেখে তার স্বপ্ন পূরণের। এত কিছুর পরেও কোন অভিযোগ নেই, বরং দৃঢ় সংকল্প আছে দেশের জন্য কিছু করার। তাঁর কণ্ঠে ছিল ক্ষোভের বদলে শান্তির বাণী, এক অটল সংকল্প—দেশের জন্য বাঁচতে হবে, কিছু করতে হবে।
আত্মত্যাগের দিনটি
২০২৪ সালের ১৮ জুলাই। বিকেল তখন পাঁচটা। মিরপুর ২ নম্বর থানার সামনে নূর এবং তার সহযোদ্ধারা অবস্থান করছিলেন। হঠাৎ আওয়ামী সন্ত্রাসীরা পুর্নিমা রেস্টুরেন্টের সামনে অস্ত্র নিয়ে উপস্থিত হয়। পুলিশ তাদের দেখে আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। নির্দয়ভাবে গুলি চালাতে শুরু করে। নূরের ডান চোখে গুলি লাগে। চোখের ৯৫ শতাংম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেদিনের সেই ভয়াবহ স্মৃতি আজও তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। “আমার চোখ হারালাম, কিন্তু যারা শহীদ হয়েছে, তাদের হারানোর কষ্ট আমার চেয়েও বেশি,” বলেন নূর।
পরিবারের দায়িত্ব আর অব্যক্ত যন্ত্রণা
নূরের পরিবারে সাত সদস্য। বাবা, যিনি একসময় পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন, এখন অসুস্থ। তার মেরুদণ্ডে অপারেশন হয়েছে, ভারী কাজ করা অসম্ভব। বড় ভাই গ্রামে প্রাইভেট পড়িয়ে পরিবারের জন্য সংগ্রাম করছেন। নূর নিজেও পড়াশোনার পাশাপাশি পরিবারকে সাপোর্ট করতেন। কিন্তু চোখ হারানোর পর তার জীবনে নেমে এসেছে অনিশ্চয়তা। “মা জানে না, আমি চোখ হারিয়েছি। তাকে কীভাবে বলব? তিনি তো এটা সহ্য করতে পারবেন না,” নূরের গলায় এক অজানা কষ্ট ধ্বনিত হয়। নিজের ভবিষ্যৎ অন্ধকার হলেও, পরিবারের জন্য তার ত্যাগ থেমে নেই।
সহযোদ্ধাদের জন্য একটি পরিবার
নূর একা নন। তার মতো আরও অনেকেই চোখ হারিয়েছেন। কেউ এক চোখে দেখতে পান না, কেউ একেবারেই অন্ধ। তবুও নূর তাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। তিনি বলেন, “আমরা একেকজন যেন জীবন্ত লাশ। তবুও আমরা একে অপরকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করেছি।” তিনি তাদের মানসিকভাবে সমর্থন দিয়েছেন, হাসপাতালে নিয়ে গেছেন, রিপোর্ট করানোর ব্যবস্থা করেছেন। তার সহযোদ্ধা সাব্বির, তামিম, সান—তারা প্রত্যেকেই এই সংগ্রামে নিজেদের হারিয়েছেন। নূর তাদের নামও তুলে ধরেন, যেন তারা কখনো বিস্মৃত না হন।
দেশের সংস্কারের দাবি এবং ভবিষ্যতের প্রত্যাশা
নূরের চোখে দেশের সংস্কারের, দেশকে বদলানোর স্বপ্ন আজও জ্বলজ্বল করছে। তাঁর আকাঙ্ক্ষা শুধু দেশকে উন্নত করা নয়, বরং সত্যের পথে চলা। তিনি বিশ্বাস করেন, হামলাকারীদের এবং তাদের ইন্ধনদাতাদের বিচারে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। সঠিক বিচার ছাড়া স্বাধীনতার আসল অর্থ পূর্ণতা পাবে না। “স্বাধীন দেশে যদি সত্য কথা বলার সুযোগ না থাকে, তবে এমন স্বাধীনতার কোনো প্রয়োজন নেই,” বলেন তিনি। নূর চান, দেশের সংস্কার হোক। তিনি বলেন, “সংস্কার ছাড়া উন্নয়ন সম্ভব নয়। আমরা যদি নিজের জীবনের ভালো সময়, শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ ও জীবন দেশ সংস্কারের জন্য ত্যাগ করতে পারি, তাহলে যারা রাজনীতিতে আছেন, তারা কেন সঠিক কাজ করবেন না?। কেন তারা সংস্কার না চেয়ে, দেশ সংস্কারের জন্য সময় না দিয়ে নির্বাচনের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।”
নুর বলেন, আমি কৃতজ্ঞ সেইসব আদর্শ নাগরিকদের প্রতি, যারা আমাদের পাশে থেকেছেন। বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানাই সিএমএইচ পরিবারকে এবং লে. কর্নেল বেলাল স্যারকে, যিনি আমাদের জন্য তাঁর অবস্থান থেকে যথাসাধ্য করেছেন। এই গল্প শুধু আমার না। এই গল্প আমাদের সবার। এটা এক অন্ধকার থেকে আলোয় আসার গল্প। একটা স্বপ্নকে না ছুঁইতে পারা একটা গল্পের শেষ হতে পারে, কিন্তু অন্যায়বিরোধী এক অমর সংগ্রামের শুরু।
সঠিক চিকিতসা পেলে চোখের আলো ফিরে পেতে পারেন বলে জানায় তার পরিবার। জুলাই ফাউন্ডেশনের সহযোগীতা পেলেও, তা দিয়ে পর্যাপ্ত চিকিতসা ব্যয় বহন করা সম্ভব হয়নি। চিকিতসার অভাবে তার চোখের আলো চিরতরে নিভে যেতে পারে। সরকারের কাছে ছেলে নুর হোসেনের চোখের দৃষ্টি ফিরিয়ে দিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করুন। ছেলের স্বপ্ন পূরণে সরকারকে এগিয়ে আসারও আহবান জানায় নুরের অসহায় পরিবার।
মো. নূর হোসেনের এই গল্প শুধু একজন যোদ্ধার ত্যাগের নয়, বরং মানবিকতার জয়গানের। নূর এবং তার সহযোদ্ধারা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন, কীভাবে দেশের জন্য আত্মত্যাগ করতে হয়। তাদের ত্যাগ যেন কখনো ভুলে না যাই। নূর তার শেষ কথায় বলেন, “ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ভয় জেনেও অন্যায়কে অন্যায় বলার সাহসই মানুষকে সত্যিকারের মানুষ বানায়। আমি চোখ হারিয়েছি, কিন্তু স্বপ্ন হারাইনি। আমার স্বপ্ন আজও জ্বলজ্বল করছে এই স্বাধীন দেশটিকে আরও সুন্দর দেখতে।”