যদি বেঁচে ফিরে আসি, তাহলে দেখা হবে: স্ত্রীকে হাবিবুল্লাহ
যদি বেঁচে ফিরে আসি, তাহলে দেখা হবে। না হলে দেশের জন্য মরব—এ কথাগুলো বলেই ২০ জুলাই সকাল সাড়ে ৭টার দিকে স্ত্রী আয়েশার অনুরোধ উপেক্ষা করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যান হাবিবুল্লাহ। গত ১৯ জুলাই সারাদেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সর্বাত্মক অবরোধের ডাক দেয়। সেই অবরোধের সময় রেন্ট-এ-কার বন্ধ থাকায় দিনগুলো তার বিশ্রামের সুযোগ ছিল, কিন্তু ঘরে বসে থাকতে পারেননি তিনি। দেশের মানুষের জন্য হৃদয় কেঁদেছিল তার। ঘরে বসে থাকা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না, কারণ আন্দোলনে দেশের সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে জীবন দিয়ে লড়াই করছে। তাই সেদিন নিজ উদ্যোগে আন্দোলনকারীদের জন্য রান্নার আয়োজন করেন, নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু সে চেষ্টা যেন তাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিল। দুপুরের দিকে পুলিশি অভিযানে তার জীবন শেষ হয়ে যায়। গুলিতে আহত হাবিবুল্লাহ রাস্তায় পড়ে থাকলেও ভয়ে কেউ তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেনি। যিনি সবার জন্য দাঁড়াতে চেয়েছিলেন, তার জীবন রাস্তায় ছটফট করতে করতে শেষ হয়ে গেল। এই মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে একটি পরিবারের সকল স্বপ্ন, আনন্দ এবং নিরাপত্তার শেষ প্রহর বেজে যায়।
হঠাৎ করে একজন পরিচিত লোক বাসায় গিয়ে জানায় হাবিবুল্লাহ গুলিবিদ্ধ রাস্তায় পড়ে আছে। পরে তার মোবাইলে কল দিলে একজন অপরিচিত লোক ফোন রিসিভ করে জানান, সে ঢাকা মেডিকেলে আছে। পরে তারা ঢাকা মেডিকেলে গিয়ে দেখেন সে মারা গেছে। দুই দিন পর্যন্ত তার মরদেহ ঢাকা মেডিকেলের মর্গে ফেলে রাখা হয়। তাদেরকে দেওয়া হয় নাই। অনেক কষ্ট করে ২০ হাজার টাকা দিয়ে ২৩ জুলাই দিবাগত রাত সাড়ে ১১টার দিকে মরদেহ বুঝে নেয় পরিবার। আশা ছিল হাবিবুল্লাহর মরদেহ গ্রামের বাড়ি দ্বীপ জেলা ভোলায় এনে দাফন করবেন। কিন্তু হাসপাতালের লোকজনের কারণে অ্যাম্বলেন্স না পেয়ে জুরাইন কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।
আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে নিহত হাবিবুল্লাহর সন্তানরা সরকার ও প্রশাসনের সহযোগিতা চেয়েছেন। নিহত হাবিবুল্লাহর একমাত্র ছেলে মো. রিয়াদ হোসেন জানান, তিনি ঢাকার একটি মাদ্রাসা থেকে হেফজ সম্পন্ন করেছেন। তার বড় বোন ফাতেমা আক্তার ২০২৪ সালে মুগদা কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে পাস করেছেন। তবে বাবার অকাল মৃত্যুর পর সংসারের খরচ চালাতে রিয়াদকে পড়ালেখা ছেড়ে একটি এমএস স্টিল কারখানায় কাজ করতে হচ্ছে।
নিহত হাবিবুল্লাহ ভোলার লালমোহন উপজেলার ধলিগৌরনগর ইউনিয়নের ৬নম্বর ওয়ার্ডের চর মোল্লাজি গ্রামের মৃত শফিউল্লাহর ছেলে।
২৫ বছর আগে নিহত হাবিবুল্লাহ'র বাবা শফিউল্লাহ মারা যাওয়ার পর অভাবের কারণে তাদের দুই ভাই ও তিন বোনকে নিয়ে মা আছিয়া খাতুন ঢাকায় চলে যান। ঢাকার যাত্রাবাড়ীর শনির আখড়া এলাকায় থেকে মানুষের বাসায় কাজ করে তাদের ভাই-বোনদের বড় করেছেন। তিন বোনকে বিয়ে দিয়েছেন। তারা দুই ভাইও বড় হয়ে কাজ করতে শুরু করেন। হাবিবুল্লাহ প্রথমে ঢাকায় রিকশা চালাতেন। পরে সিএনজি চালাতেন। সর্বশেষ রেন্ট কারের চালক হিসেবে কাজে যোগ দেন। স্ত্রী, এক ছেলে ও তিন মেয়ে নিয়ে ভালোভাবেই চলছিল তাদের সংসার।
হাবিবুল্লাহর ছোট ভাই মো. নুর উদ্দিন নূরু দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানান, ২৫ বছর আগে বাবা শফিউল্লাহ মারা যাওয়ার পর অভাবের কারণে তাদের দুই ভাই ও তিন বোনকে নিয়ে মা আছিয়া খাতুন ঢাকায় চলে যান। ঢাকার যাত্রাবাড়ীর শনির আখড়া এলাকায় থেকে মানুষের বাসায় কাজ করে তাদের ভাই-বোনদের বড় করেছেন। তিন বোনকে বিয়ে দিয়েছেন। তারা দুই ভাইও বড় হয়ে কাজ করতে শুরু করেন। ভাই হাবিবুল্লাহ প্রথমে ঢাকায় রিকশা চালাতেন। পরে সিএনজি চালাতেন। সর্বশেষ রেন্ট কারের চালক হিসেবে কাজে যোগ দেন। স্ত্রী, এক ছেলে ও তিন মেয়ে নিয়ে ভালোভাবেই চলছিল তাদের সংসার।
ছেলে মো. রিয়াদ হোসেন (১৮) ঢাকায় একটি মাদ্রাসা থেকে হেফজ শেষ করেছেন। বড় মেয়ে ফাতেমা আক্তার (২১) মুগদা কলেজ থেকে ২০২৪ সালে এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে পাশ করেছেন, মেজো মেয়ে হাবিবা (৭) বাসার পাশের একটি মাদ্রসায় প্রথম শ্রেণিতে পড়ে এবং ছোট মেয়ে হুমায়রার বয়স দুই বছর। স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে শনির আখড়া এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকতেন।
২০২২ সালে মা আছিয়া খাতুন মারা যান। মা-বাবা দুইজন মারা যাওয়ায় গ্রামের যাওয়া একেবারে ছেড়েই দিয়েছেন। এরই মধ্যে বাড়ির লোকজন তাদের পৈতৃক জমিও দখল করে নিয়েছেন। এ সকল কারণে গ্রামে যাওয়ার কোনো আগ্রহ ছিল না তাদের মধ্যে।
নিহত হাবিবুল্লাহর ছোট ভাই আরও জানান, বড় ভাই হাবিবুল্লাহ মারা যাওয়ার পর ঢাকা মেডিকেলের লোকজন তাদের সঙ্গে খুবই খারাপ আচরণ করেছেন। কিছু বললেই হাসপাতালের লোকজন বলতেন উপরের নির্দেশ। তাদের অপচিকিৎসার কারণেই হাবিবুল্লাহর মৃত্যু হয়েছে বলে দাবি করেন নুর উদ্দিন।
এদিকে হাবিবুল্লাহ মারা যাওয়ার পর তার একমাত্র ছেলে হাফেজ মো. রিয়াদ হোসেন সংসারের খরচ জোগাতে পড়ালেখা ছেড়ে একটি এমএস স্টিল কারখানায় চাকরি নিয়েছেন। বাবার অবর্তমানে পরিবারের বোঝা এখন তার কাঁধে। বোনদের পড়ালেখা ও সংসারের খরচ জোগাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয় তাদের। তাই পরিরের যে কোনো একজনকে একটি সরকারি চাকরি দেওয়ার দাবি করেন তারা।
আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে নিহত হাবিবুল্লাহর ছেলে মো. রিয়াদ হোসেন বড় মেয়ে ফাতেমা আক্তার বলেন, পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী ছিল আমার বাবা। তিনিতো কোনো ধরনের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল না। এমনকি সে তো ছাত্রও ছিল না। তাকে কেন তারা মারল? কি দোষ ছিলো আমার বাবার? যারা তাকে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করেছে তাদের উপযুক্ত বিচার দাবি করেন নিহত হাবিবুল্লাহর সন্তানেরা।
তারা আরোও বলেন, আমি ঢাকায় একটি মাদ্রাসা থেকে হেফজ শেষ করেছি। এবং আমার বোন মুগদা কলেজ থেকে ২০২৪ সালে এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে পাশ করেছেন। সরকার যদি আমাদের দুই ভাই বোনের একজনকে একটা চাকরি দিতো তাহলে ছোট বোনদের পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি পরিবারটা কোনোমতে চলে যেতো।