স্বামী প্রধান শিক্ষক হওয়ায় স্কুলে না গিয়ে নিয়মিত বেতন-ভাতা তুলছেন স্কুল শিক্ষিকা
স্বামী প্রধান শিক্ষক-এই সুযোগে ৯ বছরে একদিনও স্কুলে যাননি ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার মুজিব নগর ইউনিয়নের চর নিউলিন বাংলাবাজার মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা জান্নাতুল ফেরদাউস নুপুর।
গত সোমবার (৯ ডিসেম্বর) স্কুল চলাকালীন সময়ে সহকারী শিক্ষক (গণিত) মো. লাবলুকে মারধরের ঘটনার অনুসন্ধান করতে গিয়ে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে অর্ন্তহীন অভিযোগ উঠে এসেছে। মো. লাবলু ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কামাল হোসেন ও এনটিআরসি কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষক।
জানা যায়, ২০০০ সালে চর নিউলিন বাংলাবাজার নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর ২০১০ সালে বিদ্যালয়টি এমপিওভুক্ত হয়েছে। বর্তমানে ওই বিদ্যালয়ে ১৯৫ জন শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত রয়েছে।
বিদ্যালয়ের জমিদাতা জহিরুল ইসলাম বাবুল জানান, ২০১৫ সালে প্রধান শিক্ষকের স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদাউস এই বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক পদে নিয়োগ পান এবং ২০১৭ সালে এমপিওভুক্ত হয়ে বেতন-ভাতা পাচ্ছেন নিয়মিত। কিন্তু গত ৯ বছরে একদিনও তিনি স্কুলে আসেননি। স্বামী কামাল উদ্দিন প্রধান শিক্ষক নিজেই স্ত্রীর হয়ে হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করছেন। এসব বিষয়ে স্কুল কমিটি এবং অভিভাবকরা সম্প্রতি সময়ে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার ও উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে অবহিত করেছেন। কিন্তু রাজনৈতিক দাপটের কারণে কেউ তাদের অভিযোগগুলো আমলে নেয়নি।
ওই বিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী মো. নাফিস বলে, ‘৬ষ্ঠ থেকে ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত ৫ বছর লেখাপড়া শেষে ২০২৩ সালে আমি এই বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করে বের হয়েছি। কিন্তু দীর্ঘ ৫ বছরে জান্নাতুল ফেরদাউস নামে কোন শিক্ষিকাকে এই বিদ্যালয়ে দেখিনি।’
বিদ্যালয়ের অধ্যয়নরত শিক্ষার্থী ৮ম শ্রেণির সাকিব জানায়, বিদ্যালয়ে ৬ষ্ঠ থেকে ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের মাসিক বেতন ৫৫০ টাকা থেকে ১ হাজার টাকা পর্যন্ত নেয়া হয়। পাশাপাশি স্কুলের পরীক্ষার ফি নেয়া হয় ৫০০ থেকে ৮০০ টাকা পর্যন্ত। চলতি এসএসসির ফরম পূরণের জন্য শিক্ষার্থী প্রতি সাড়ে ৫ হাজার টাকা নেয়া হয়েছে। এমন গলাকাটা বেতন-ফি নেয়ার পরও প্রতি মাসে শিক্ষকের বেতন বাবদ ৫০ টাকা এবং বিদ্যুৎ বিল বাবদ আরো ৫০ টাকা করে নেয়া হচ্ছে। এসব গলাকাটা ফি, বেতন এবং বাড়তি টাকা নেয়া হলেও এসব দেখার কেউ নেই।
শিক্ষার্থী সিয়াম এবং মিহাদ অভিযোগ করে, জান্নাতুল ফেরদাউস ম্যাডাম স্কুলে আসেন না, তার বদলে একজন প্যারা শিক্ষক রায়হান স্যার ক্লাস নেন। কিন্তু এই রায়হান স্যারের বেতনের জন্য আমাদের মাসে ৫০ টাকা করে দিতে হচ্ছে এবং আমরা বাধ্য হয়ে তা দিচ্ছি।
বিদ্যালয়ের অফিস সহকারী জাকির হোসেন জানান, ২০০০ সাল থেকে বিদ্যালয়ের উন্নয়ন বরাদ্দ, অর্জিত খাতের সকল আয় প্রধান শিক্ষক নিজে নিয়ে যান। তারপরও প্রতি বছর রিজার্ভ তহবিলের টাকা জমার নামে শিক্ষকদের কাছে মোটা অঙ্কের টাকা নিচ্ছেন। এবছর শিক্ষকরা ওই টাকা দিতে অস্বীকার করছেন। ফলে প্রধান শিক্ষকের সাথে সহকারী শিক্ষকদের সম্পর্কের টানাপড়েন শুরু হয়। রোববার বিষয়টি নিয়ে প্রধান শিক্ষক সহকারী শিক্ষকদের সাথে আলোচনায় বসেন। বিদ্যালয়ের অফিসকক্ষে ওই আলোচনায় কিছুটা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে।
সহকারী শিক্ষক মো. লাবলু জানান, প্রধান শিক্ষক রিজার্ভ তহবিলে জমা দেয়ার জন্য সহকারী শিক্ষকদের কাছে ১ লাখ ৭৫ হাজার টাকা চেয়েছেন। আমি ওই টাকা নিতে হলে ২০২২ এবং ২০২৩ এই ২ বছরের অর্জিত আয়ের হিসেব দেয়া, বিদ্যালয়ের অর্থ কমিটি গঠন এবং ওই কমিটির মাধ্যমে টাকা নেয়ার প্রস্তাব করলে প্রধান শিক্ষক উত্তেজিত হয়ে আমার সাথে বাজে আচরণ করেছেন।
অভিযুক্ত সহকারী শিক্ষিকা জান্নাতুল ফেরদাউস নুপুর বিদ্যালয়ে না যাওয়ার বিষয় অস্বীকার করে বলেছেন, বিচ্ছিন্ন এলাকায় স্কুল হওয়ায় তিনি মাঝে মধ্যে স্কুলে যেতে পারেন না। তাই মাসে ৫ হাজার টাকা করে ২ জন প্যারা শিক্ষকের বেতন আমি দিয়ে যাচ্ছি। কত টাকা বেতন পাই আর কত ই বা থাকে। স্বামী আওয়ামীলীগ করায় এখন এসব কথা উঠছে।
প্রধান শিক্ষক কামাল হোসেন তার বিরুদ্ধে তোলা সব অভিযোগ মিথ্যা বলে দাবি করেছেন।
উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার মো. মহিউদ্দিন বলেছেন, এই প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে সীমাহীন অভিযোগ আসছে। আমি আগেও তাকে সতর্ক করেছি। লাভ হয়নি। শিক্ষকদেরকে উপজেলা নির্বাহী অফিসার বরাবরে লিখিত অভিযোগ দেয়ার জন্য পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
বিদ্যালয়ের এডহক কমিটির সভাপতি ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার রাসনা শারমিন মিথি জানান, বিষয়টি খতিয়ে দেখে খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে ওই সহকারী শিক্ষক ও প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।