১৩ সিনিয়রকে ডিঙিয়ে উপাচার্য হওয়া ড. লুৎফুরকে নিয়ে অভিযোগ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে
চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের (সিভাসু) এনাটমি ও হিস্টোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ লুৎফুর রহমান। গত ৫ আগস্ট ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অক্টোবরে এই অধ্যাপককে সিভাসু’র উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। তবে উপাচার্য হিসেবে তাকে নিয়োগের পরেই বিশ্ববিদ্যালয়জুড়ে সমালোচনার সৃষ্টি হয়। সম্প্রতি এই উপাচার্যের বিরুদ্ধে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে একটি আবেদনও জমা পড়ে।
গত ১২ জানুয়ারি শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের কাছে এই উপাচার্যের অপসারণ চেয়ে একটি আবেদন জমা দেন মুজিবুর রহমান নামে বিশ্ববিদ্যালয়টির সাবেক এক শিক্ষার্থী। আবেদনে প্রশাসনিক স্বেচ্ছাচারিতা এবং অনিয়মের অভিযোগ তুলে সিভাসু উপাচার্য মোহাম্মদ লুৎফুর রহমানকে অপসারণের দাবি জানান তিনি।
আবেদনে বলা হয়, শিক্ষক হওয়ার যোগ্যতা না থাকলেও অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ লুৎফুর রহমান বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য পদে রয়েছেন। এছাড়াও উপাচার্য পদে তার চেয়ে বেশি অভিজ্ঞতা ও যোগ্যতাসম্পন্ন অন্তত ১৩ জন অধ্যাপক বিশ্ববিদ্যালয়টিতে কর্মরত রয়েছেন। উপাচার্য পদে বসা এই অধ্যাপক তার স্নাতকের সংশ্লিষ্ট বিষয়ে টেনেটুনে পাস করলেও বিষয়টি নজরে নেয়নি শিক্ষা মন্ত্রণালয়। বিষয়গুলো নিয়ে বিস্ময় ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বিভিন্ন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা।
অধ্যাপক লুৎফুর রহমানের স্নাতক পর্যায়ের মার্কসিট ঘেটে দেখা গেছে, এনাটমিতে অধ্যাপক হিসেবে শিক্ষকতা করলেও স্নাতক পর্যায়ে ওই বিষয়ে মাত্র ৩২ নম্বর পেয়েছিলেন এবং পরবর্তীতে ৮ নাম্বার গ্রেস নিয়ে তাকে পাস করানো হয়। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়টির অধ্যাপনায় কর্মরত প্রথম গ্রেডের অন্তত এক ডজন সিনিয়র শিক্ষক থাকলেও এই অধ্যাপককে উপাচার্য পদে নিয়োগ দেয়ার প্রতিবাদ জানিয়েছেন একাধিক সাবেক শিক্ষার্থী ও বর্তমান শিক্ষকরা।
‘সরকার যাচাই বাছাই করেই আমাকে এই পদটিতে নিয়োগ দিয়েছে। ফলে আমার যোগ্যতা সম্পর্কে অপপ্রচার চালালে কোনো ফলাফল আসবে না। এটার পেছনে আগের সুবিধাভোগীরাও জড়িত আছেন— অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ লুৎফুর রহমান, উপাচার্য, সিভাসু
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি মেডিসিন অনুষদের একজন অধ্যাপক বলেন, অধ্যাপক লুৎফুর রহমানকে উপাচার্য পদে নিয়োগ দেয়ায় অন্য সিনিয়র অধ্যাপকগণ হতাশ হয়েছেন। উপাচার্য পদের মতো সংবেদনশীল এবং জনগুরুত্বপূর্ণ পদে সুস্পষ্ট অভিযোগ থাকা এমন ব্যক্তিকে নিয়োগ দেয়ায় প্রশ্ন তৈরি হয়েছে, কার স্বার্থে এবং কত টাকা অর্থ লেনদেন হলে সিনিয়রদের ডিঙিয়ে স্নাতকে টেনেটুনে পাশ করা ব্যক্তি উপাচার্য পদে আসীন হতে পারেন। বিষয়টি সিভাসুর ভবিষ্যৎসহ অর্জিত সকল সুনাম এবং গ্রহণযোগ্যতাকে হুমকির মুখে ফেলেছে। আমরা অবিলম্বে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে এই উপাচার্যের নিয়োগ পুনর্বিবেচনার দাবি জানাচ্ছি।
আরো পড়ুন: নিজ ক্যাম্পাসের শিক্ষককে ভিসি হিসেবে পেতে উত্তাল সিভাসু
শিক্ষা উপদেষ্টা বরাবর আবেদনে সিভাসুর বর্তমান এই উপাচার্যের বিরুদ্ধ আরও অভিযোগ, নিয়ম অনুযায়ী উপাচার্যদের সার্বক্ষণিক ক্যাম্পাস অবস্থান করার কথা থাকরলেও দায়িত্ব গ্রহণের পরও বিশ্ববিদ্যালয়টিতে সব সময় অবস্থান করেন না। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের দাবি, নিয়োগের পর থেকে প্রায় ৯০ কর্মদিবসের মধ্যে মাত্র ২০ শতাংশ কার্যদিবস তিনি ক্যাম্পাসে উপস্থিত ছিলেন; বাকি ৮০ শতাংশ কার্যদিবস ছিলেন ক্যাম্পাসের বাহিরে। আবার ছুটি কিংবা অন্য কোন কারণে কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকলে বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুসারে উপাচার্য পদের দায়িত্বে ট্রেজারার বা জ্যেষ্ঠ অধ্যাপককে দায়িত্ব অর্পণের কথা থাকলেও নিজের ইচ্ছামতো একজন শিক্ষককে দায়িত্ব দিয়ে থাকেন তিনি।
‘যার নিয়োগ আরো বেশি যোগ্যতাসম্পন্ন অধ্যাপকদের বঞ্চিত করে। উপাচার্যের স্নাতক পর্যায়ের ফলাফল নিয়ে বেশ বিতর্ক রয়েছে। উপাচার্য হিসেবে নিয়োগের পরেও তিনি দুটি অনুষদের ডিন পদ আঁকড়ে ধরে রেখেছেন। এটা কীভাবে যৌক্তিক হল? রিলেটেড ডিপার্টমেন্টের অধ্যাপকদের ডিন পদে নিয়োগ দেয়া যেত। তার কোনোটাই এই উপাচার্য করেননি।’
তবে বিষয়টিকে উড়িয়ে দিয়েছেন উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ লুৎফুর রহমান। দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে তিনি বলেন, এমন অভিযোগের কোনো ভিত্তি নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজে আমাকে ঢাকায় যাতায়াত করতে হয়। ব্যক্তিগত কোনো কাজের পেছনে সময় নষ্ট করার প্রশ্নই উঠে না। আমি শুধু ৯টা-৫টা অফিস করি না; বরং বেশিরভাগ সময় ৯টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত অফিস করি। ফলে যারা এসব অভিযোগ করছেন, তাদের এমন দাবির কোনো ভিত্তি নেই।
সম্প্রতি উপাচার্য নিয়োগের আগে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রথম ও দ্বিতীয় গ্রেডে কর্মরত ২৪ জন অধ্যাপকের নামের তালিকা পাঠায় কর্তৃপক্ষ। তালিকায় উপাচার্য লুৎফুর রহমানকে দ্বিতীয় গ্রেডের অধ্যাপক এবং ১৪ নাম্বার ক্রমে রাখা হয়। যদিও উপাচার্য পদে নিযুক্ত হওয়ার জন্য বিষয়টি তেমন গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন না উপাচার্য।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য অধ্যাপকদের চেয়ে আমার অভিজ্ঞতা এবং ব্যাকগ্র্যাউন্ড অনেক শক্তিশালী। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা কিংবা অস্ট্রেলিয়াসহ পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোর বড় বড় স্কলারশিপগুলো আমি বিভিন্ন সময় পেয়েছি। খুব কম শিক্ষকের সিভিতে আপনি এমনটি দেখতে পাবেন। তালিকায় কত নাম্বারে ছিলাম সেটা আমার দেখার বিষয় না। আমি কতটা যোগ্য সেটাই মুখ্য।
আরো পড়ুন: একদিনে ৪ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগ দিল সরকার
শিক্ষা উপদেষ্টা বরাবর আবেদন করা সাবেক শিক্ষার্থী মুজিবুর রহমান দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আমার অভিযোগ একটাই, বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগ্যতাসম্পন্ন অন্তত ১৩ জন অধ্যাপককে ডিঙিয়ে কেন এমন একজনকে উপাচার্য করা হলো; যিনি স্নাতক পর্যায়ে অধ্যাপনার সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ৩২ পেয়েছিলেন। পরে ৮ নাম্বার যোগ করে তাকে পাস করানো হয়। আমি মনে করি, এখানে একটি সিন্ডিকেট জড়িত আছেন। যাদের কাছে যোগ্যতা কোনো বিষয় না। নিজেদের লোকদের কোনোরকম যোগ্যতা বিবেচনা না করেই তারা নিয়োগ দিতে মরিয়া হয়ে ওঠেন।
তিনি আরও বলেন, জুলাই অভ্যুত্থানে এত রক্ত ঝরেছে ন্যয় প্রতিষ্ঠার জন্য। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে বিতর্কের ঊর্ধ্বে কোনো ব্যক্তি এল না। এমন নয় যে, যোগ্যতাসম্পন্ন কেউ ছিলেন না। বরং তাদের বঞ্চিত করেই অধ্যাপক লুৎফুর রহমানকে উপাচার্য পদে বসানো হয়েছে। এখানে একটি চক্র কাজ করছে। একজন সাবেক শিক্ষার্থী হিসেবে বিষয়টি আমাদের জন্য বিব্রতকর। অবিলম্বে ন্যয় প্রতিষ্ঠা হোক সেটাই আমাদের দাবি।
বিষয়গুলো নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির একাধিক শিক্ষক। তবে বিড়ম্বনা এড়াতে তারা নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি। তাদের ভাষ্য, আমরা এমন কাউকে উপাচার্য পদে চাই না, যার নিয়োগ আরো বেশি যোগ্যতাসম্পন্ন অধ্যাপকদের বঞ্চিত করে। উপাচার্যের স্নাতক পর্যায়ের ফলাফল নিয়ে বেশ বিতর্ক রয়েছে। উপাচার্য হিসেবে নিয়োগের পরেও তিনি দুটি অনুষদের ডিন পদ আঁকড়ে ধরে রেখেছেন। এটা কীভাবে যৌক্তিক হল? রিলেটেড ডিপার্টমেন্টের অধ্যাপকদের ডিন পদে নিয়োগ দেয়া যেত। তার কোনোটাই উপাচার্য করেননি।
সামগ্রিক অভিযোগের বিষয়ে উপাচার্য বলেন, আমি উপাচার্য পদে নিয়োগ পাওয়ার পর এখনো বিশ্ববিদ্যালয়কে গুছিয়ে নিতে পারিনি। গুরুত্বপূর্ণ পদে কাউকে দায়িত্ব দিতে গেলে দেখা যায়, তারা পূর্বের ফ্যাসিস্ট আমলে সুবিধাভোগী ছিলেন। তবে একাই দুটি অনুষদের ডিনের দায়িত্ব পালন নিয়ে আমার ভিন্ন কোনো উদ্দেশ্য নেই। আমার নিজ অনুষদে উপাচার্য পদে নিযুক্ত হওয়ার আগে থেকেই দায়িত্বরত আছি। আর আরেকটি অনুষদের সিনিয়র শিক্ষক না থাকায় আমি দায়িত্ব পালন করছি।
উপাচার্য আরও বলেন, আমার পেছনে কিছু স্বার্থান্বেষী শিক্ষক ও সাবেক শিক্ষার্থীরা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছেন। তারা বিভিন্ন মহলের কাছে আমাকে হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টায় লিপ্ত। কিন্তু আমি মনে করি সরকার যাচাই বাছাই করেই আমাকে এই পদটিতে নিয়োগ দিয়েছে। ফলে আমার যোগ্যতা সম্পর্কে অপপ্রচার চালালে কোনো ফলাফল আসবে না। এটার পেছনে আগের সুবিধাভোগীরাও জড়িত আছেন।
স্নাতকের ফলে মেধা তালিকায় ৪৮তম ছিলেন ড. লুৎফুর রহমান
ড. লুৎফুর রহমান বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০০০ সালে ডক্টর অব ভেটেরিনারি মেডিসিনে (ডিভিএম) স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এনাটমিতে মাস্টার্স ডিগ্রিও লাভ করেন। পরবর্তীতে ২০০১ সালে তৎকালীন চট্টগ্রামের ভেটেরিনারি কলেজে (বর্তমানে সিভাসু) এনাটমি ও হিস্টোলজি বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। পরবর্তীতে ২০০৬ সালে এক অধ্যাদেশের মাধ্যমে এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের (সিভাসু) যাত্রা শুরু করে।
তার স্নাতকের ট্রান্সক্রিপ্টে দেখা যায়, তিনি দ্বিতীয় শ্রেণি পেয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৯৩-৯৪ সেশন থেকে ১৯৯৬-৯৭ সেশনের তার সঙ্গে ৬৫ জন পরীক্ষায় অংশ নেন। এর মধ্যে মেধা তালিকায় ড. লুৎফুর রহমানের অবস্থান ৪৮তম। পরীক্ষায় অংশ নেওয়া ৫৬ জনের মধ্যে প্রথম শ্রেণি পেয়ে ১২ জন এবং দ্বিতীয় শ্রেণি পেয়ে ৫৩ জন উত্তীর্ণ হয়েছিলেন।