১৯ মার্চ ২০২৫, ১২:৫৬

মাত্র দুজন কর্মকর্তা দিয়ে চলছে জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউটের কার্যক্রম

জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল

প্রশাসনিক জনবল সংকট, সার্বিক ব্যবস্থাপনায় ও পরিচালনায় নানা জটিলতার কারণে গুরুত্ব হারাচ্ছে জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল। সেবাপ্রত্যাশীরা এমন নানা অব্যবস্থাপনার সম্মুখীন হচ্ছে প্রতিনিয়ত, এতে তারা বিরক্তি ও হতাশা প্রকাশ করছেন।

সম্প্রতি জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল পরিদর্শনে গেলে এমন চিত্র দেখা যায়।  তবু যেন টনক নড়ছে না কর্তৃপক্ষের।

ধানমন্ডি থেকে আসা ফুসফুসে আক্রান্ত রোগীর ভাই সেলিমুজ্জামান (৫০) বলেন, আমি আমার বোনকে চিকিৎসার জন্য এই হাসপাতালে নিয়ে এসেছি। আমার বোনের ফুসফুসে সমস্যা রয়েছে। যে কারণে তাকে এখানে ভর্তি করিয়েছি। আমি তাকে গত ২ মার্চ হাসপাতালে ভর্তি করেছিলাম। কিন্তু এখানে এসে যে ধরনের অব্যবস্থাপনার সম্মুখীন হয়েছি, তা অত্যন্ত হতাশাজনক। 

নায়েমের বর্তমান পরিচালক হিসেবে কাজ করছেন জানিয়ে তিনি আরও বলেন, আমার দৃঢ় বিশ্বাস এই হাসপাতালের চিকিৎসাব্যবস্থা উন্নত করতে হলে শুধু চিকিৎসকদের দক্ষতার ওপর নির্ভর না হয়ে, রোগী এবং প্রযুক্তির ক্ষেত্রেও যথাযথ বিনিয়োগ করা উচিত। শুধু চিকিৎসক নয়, আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে সঠিক ও দ্রুত চিকিৎসা নিশ্চিত করা সম্ভব।

এ ছাড়া খরচের বিষয়ে মন্তব্য করে তিনি বলেন, যদিও এই হাসপাতালের খরচ প্রাইভেট হাসপাতালের তুলনায় কিছুটা কম, তবু এখানে চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতি হলে রোগীরা আরও ভালো সেবা পাবে।

জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের প্রশাসনিক দুর্বলতার কারণে প্রশাসনিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে বলে স্বীকার করেছেন পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. দেলোয়ার হোসাইন।

তিনি বলেন, বর্তমানে প্রশাসনে শুধু পরিচালক ও সুপারিনটেনডেন্ট রয়েছে। প্রশাসনিক জনবল না থাকায় কার্যক্রম পরিচালনায় জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছে। বারবার আবেদন করেও কোনো সমাধান না আসায় সমস্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। ফলে হাসপাতালের সার্বিক ব্যবস্থাপনায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

তিনি বলেন, আমাদের হাসপাতালের লজিস্টিক সাপোর্টের অপ্রতুলতা রয়েছে। ডাক্তার, নার্স ও অন্যান্য স্টাফের জনবল সংকটের কারণে পরিষেবার মানের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। আমরা জনবল সংকট কমানোর জন্য প্রশাসনের নিকট বারবার আবেদন জানিয়েছি। কিন্তু এখনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। ফলে প্রশাসনিক জটিলতা দিন দিন বাড়ছে। বর্তমানে প্রশাসনে শুধু পরিচালক ও সুপার ইন্ডেন্ট রয়েছেন, যা সমস্যার সমাধানে যথেষ্ট নয়।

জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউটে তিনটি কোর্স চলমান রয়েছে। প্রথমত, এমডি (মেডিক্যাল ডিগ্রি) কোর্সটি ৫ বছরের মেয়াদি। এই কোর্সের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা চিকিৎসা পেশায় দক্ষতা অর্জন করে এবং মেডিকেল জ্ঞান লাভ করে। দ্বিতীয়ত, ডিটিসিটি (ডিপ্লোমা ইন ক্লিনিক্যাল সেন্টার টেকনোলজি) কোর্সটি ১ বছরের মেয়াদি, যেখানে শিক্ষার্থীরা ক্লিনিক্যাল টেকনোলজি সম্পর্কিত বিভিন্ন দক্ষতা অর্জন করেন। তৃতীয়ত, এমএস থ্রোয়ার্সিস সার্জারি কোর্সটি ৫ বছরের মেয়াদি, যা সার্জারি বিশেষজ্ঞ হিসেবে শিক্ষার্থীদের প্রস্তুত করে। প্রতিটি কোর্সের শিক্ষার্থীরা সকাল ও রাতের শিফটে রোগীদের নিয়ে কাজ করে থাকেন এবং তারা তাদের প্র্যাকটিক্যাল দক্ষতা বাড়াতে পারেন।

অধ্যাপক ডা. মো. দেলোয়ার হোসাইন বলেন, আমাদের এখানে রিসার্চ কার্যক্রম একটি একাডেমিক অংশ। প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জন্য এখানে থিসিস লেখা বাধ্যতামূলক। এটি তাদের একাডেমিক উন্নতির জন্য অপরিহার্য। আমরা প্রতিটি  শিক্ষার্থীর জন্য নির্দিষ্ট গবেষণার বিষয় নির্বাচন করে দিই। এরপর তারা নির্ধারিত বিষয় নিয়ে গবেষণা করে এবং তার ভিত্তিতে থিসিস তৈরি করে। এই গবেষণা প্রক্রিয়া শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা, বিশ্লেষণাত্মক চিন্তাভাবনা এবং বৈজ্ঞানিক দক্ষতা উন্নত করতে সহায়তা করে। ফলে এটি তাদের পেশাগত জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

হাসপাতালটিতে আসা বেশির ভাগ রোগী মূলত ফুসফুসে আক্রান্ত। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে গবেষণায় জানা গেছে, ফুসফুসে ক্যান্সার হওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ হলো স্টোন ওয়ার্কারদের ধুলার সংস্পর্শ। এই ধুলা দীর্ঘদিন ধরে শ্বাসপ্রশ্বাসের মাধ্যমে ফুসফুসে প্রবেশ করলে তা বিভিন্ন ধরনের ফুসফুসের রোগ সৃষ্টি করতে পারে। এর মধ্যে ক্যান্সার, এজমা এবং অন্যান্য শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা অন্তর্ভুক্ত। বিশেষ করে যারা স্টোন ওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত, তারা এই ধুলার কারণে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন। এবং তাদের মধ্যে ফুসফুসের রোগের ঝুঁকি অনেকটাই বেড়ে যায়-তিনি যোগ করেন।

পরিচালক বলছেন, আমাদের সফলতা হলো, এজমা নিয়ে গবেষণা ও কাজ করা। এই গবেষণার জন্য আমরা সারা দেশকে ৬০টি অঞ্চল ভাগ করি এবং প্রতিটি অঞ্চলের মধ্যে এ ধরনের রোগ কাদের মধ্যে বেশি এবং কাদের মধ্যে কম হচ্ছে তা সুনির্দিষ্টভাবে নির্ধারণ করেছি। এর মাধ্যমে আমরা প্রতিটি অঞ্চলের জন্য একটি শতাংশ তৈরি করেছি। এটি এজমার বিস্তার ও সংক্রমণের পরিসংখ্যান জানাতে সাহায্য করে। গবেষণার ফলে আমরা একটি জার্নাল প্রকাশ করেছি। যেখানে দেখা গেছে, আমাদের দেশে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ রোগী এজমায় আক্রান্ত। এই গবেষণা আমাদের দেশের এজমার পরিস্থিতি বুঝতে এবং ভবিষ্যতে আরও কার্যকর ব্যবস্থা নিতে সহায়তা করেছে।

অধ্যাপক দেলোয়ার হোসাইন উল্লেখ করে বলেন, শিক্ষার্থীরা তাদের একাডেমিক ও পেশাগত দক্ষতা উন্নয়নের লক্ষ্যে সেমিনার, সেম্পোজিয়াম ও ওয়ার্কশপের মাধ্যমে ধারাবাহিকভাবে আইডিয়া বিনিময় করে থাকেন। এসব অনুষ্ঠানে বিদেশি স্পিকারদের উপস্থিতি শিক্ষার্থীদের মধ্যে নতুন ধারণা সৃষ্টি করতে সহায়তা করে; যা তাদের সমগ্র শিক্ষা ও গবেষণার মানকে আরও উন্নত করে।