২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৪:৫৫

স্বামী ফেলে গেছেন, একমাত্র ছেলে শহীদ, ববির চিন্তা একটাই— ‘আমাকে দেখবে কে?’

মা ববি আক্তারের সঙ্গে ইমন হাসান আকাশ

ইমন হাসান আকাশ (২২)। জন্মের এক বছরের মাথায় তার বাবা তাকে ও তার মাকে ছেড়ে চলে যায়। অর্থসংকটের কারণে এসএসসি পাস করার পর আর পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারেননি আকাশ। সংসারের হাল ধরতে চাকরি করতেন একটি কুরিয়ার সার্ভিসে। মা ববি আক্তারের সঙ্গে ছিল (৪৫) ছোট্ট সংসার। কিন্তু একটি গুলিতে সে সংসারে নেমে আসে কালো ছায়া।  

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গত বছরের ৪ আগস্ট সন্ধ্যায় মিরপুর-১০ নম্বরে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান আকাশ। তার মাথার ডান পাশে গুলি লেগে বাম দিক দিয়ে বেরিয়ে যায়। পরদিন ৫ আগস্ট সকাল ৮টার দিকে মাদবরকান্দি গ্রামের কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।  

রাজধানীর মিরপুর পল্লবী থানার ৫ নম্বর ওয়ার্ডের ভাড়া বাসায় রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা বাসস-এর প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে এসব তথ্য জানান ববি আক্তার।  

ববি আক্তার বলেন, ‘অন্যের বাড়িতে কাজ করে, অনেক কষ্ট করে, খেয়ে না খেয়ে আকাশকে বড় করেছিলাম। ছেলেকে নিয়ে আমার অনেক স্বপ্ন ছিল। কিন্তু আমার সব স্বপ্ন শেষ হয়ে গেল। এখন যেদিকে তাকাই, আমি শুধু অন্ধকার দেখি। আমি কী নিয়ে থাকব, কীভাবে কাটবে আমার দিন?’ 

শহীদ আকাশের মায়ের ভাষ্য, ‘আমার আকাশ আমার কাছে নেই, সে আমাকে রেখে অনেক দূরে চলে গেছে। আমার বুকটা খালি হয়ে গেছে। ওর কথা মনে হলেই বুক ফেটে কান্না আসে। সাত মাস আমার সন্তান আমাকে মা বলে ডাকে না। ওকে  ছাড়া এখন দিনও ফুরায় না, রাতও কাটে না। অনেক কষ্ট নিয়ে বেঁচে আছি। এখনও সন্ধ্যা হলেই মনে হয়, এই বুঝি আকাশ এসে আমাকে মা বলে ডাকবে। বলবে, মা, বিরিয়ানি খাব? রান্না করে দাও। বেঁচে থাকতে কত বকা দিতাম এসব খাবার খাওয়ার জন্য। এখন এসব কথা মনে হলে বুকটা ফেটে যায়। আল্লাহ কেন আমার কাছ থেকে সবকিছু কেঁড়ে নিলেন?  আমার আর কেউ রইল না। এখন আমাকে দেখবে কে?’

ছেলের মৃত্যুর ঘটনার বর্ণনা দিয়ে ববি বলেন, ‘ওইদিন ওর বন্ধুরা মেসেজ পাঠায় মোবাইলে। এরপর আমি জানতে চাই, কোথায় যাবি? আকাশ বলে, আমি আদালতে যাব।তখন আমি বলি, তুমি আমার একমাত্র ছেলে, তোমার কিছু হলে আমার কেউ থাকবে না। আন্দোলন চলাকালে সে ছাত্রদের পানি খাওয়াচ্ছিল, আবার কখনো আহতদের হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছিল। মিরপুর-১১ নম্বরে আমাদের বাসা। সেদিন প্রথমে ইসিবি চত্বর গিয়ে মিরপুর-১০ নম্বরে যায়।’

তিনি আরও বলেন, ‘কিছুক্ষণ পর আমি মোবাইল কল দিয়ে জানতে চাই, ‘কোথায় আছিস? সে বলে, আমি আসছি আম্মু, তুমি চিন্তা করো না। আমি তখন তাকে বলি, তুমি ভাত খেয়ে আসো বাসায়। সে বলে, আমার জন্য ভাত রেখে দিও, তুমি খেয়ে নাও। আমি এসে ভাত খাব। আবার দুপুরে কল দিলে ও বলে, আম্মু, তুমি খেয়ে ঘুমিয়ে থাকো, আমি বন্ধুদের সঙ্গে বাইরে খাচ্ছি। এরপর আমি ঘুমিয়ে যাই। ঘুম থেকে উঠে বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে আবার কল দিই। কিন্তু ফোন রিসিভ করে না। পরে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে ওর এক বন্ধু কল দিয়ে বলে, আন্টি আকাশ মারা গেছে। আমি তখন কান্নাকাটি শুরু করি।’

আকাশের মায়ের ভাষ্য, ‘এরপর আমার ভাইয়ের কাছে কল দিয়ে বলি, আকাশ নাকি মারা গেছে। সে তখন সব জায়গায় খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারে, আকাশ গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর ওর বন্ধুরা মিরপুর-১০ নম্বর ডা. আজমল হাসপাতালে নিয়ে যায়, সেখানেই চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। পরে আমি হাসপাতালে গিয়ে ওর লাশ বাসায় নিয়ে আসি। এরপর শরীয়তপু্রে আমার বাবার বাড়িতে নিয়ে গিয়ে আকাশকে দাফন করা হয়।’ 

ববি আক্তার জানান,বর্তমানে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্ত চাপ ও হার্টের সমস্যায় ভুগছেন তিনি। ঠিকমতো কাজ করতে পারেন না। মাসে ওষুধ কিনতে খরচ হয় পাঁচ হাজার টাকা। বাড়ি ভাড়া দিতে হয় পনেরো হাজার টাকা।’

কারও কাছ থেকে কোনো সহযোগিতা পেয়েছেন কি না জানতে চাইলে ববি আক্তার বলেন, ‘জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে পাঁচ লাখ টাকার চেক ও জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে ২ লাখ টাকা পেয়েছি।’

ছেলেকে শহীদের মর্যাদা প্রদানের আর্জি জানিয়ে মা ববি আক্তার বলেন, ‘আমার এতটুকু চাওয়া, যে মানুষটি দেশের জন্য জীবন দিয়েছে, সে যেন যথাযথ সম্মান পায়। আমার ছেলেকে যেন শহীদের মর্যাদা দেওয়া হয়।’