১৭ জানুয়ারি ২০২৫, ১০:১৯

মাভাবিপ্রবিতে এক পক্ষ চায় ছাত্র সংসদ নির্বাচন, আরেক পক্ষ সংস্কার

মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (মাভাবিপ্রবি) ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। এটি প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা নিয়ে নিজেদের মতামত প্রকাশ করছেন বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীরা। তারা মনে করেন, ছাত্র সংসদ একটি দলীয় রাজনীতিমুক্ত, গণতান্ত্রিক প্ল্যাটফর্ম হিসেবে শিক্ষার্থীদের অধিকার রক্ষা, নেতৃত্ব বিকাশ এবং অ্যাকাডেমিক ও প্রশাসনিক পরিবেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

অনেকেই এ প্রক্রিয়ায় প্রাসঙ্গিক সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছেন। ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে দুই ধরনের মত লক্ষ্য করা গেছে। একপক্ষ দ্রুত নির্বাচন আয়োজনের পক্ষে, তাঁদের দাবি- নির্বাচনের মাধ্যমে ছাত্রদের অধিকার এবং সমস্যা দ্রুত সমাধান করা যাবে। আরেক পক্ষের মতামত, আগে কিছু সংস্কার এবং প্রস্তুতি দরকার, যাতে নির্বাচন সুষ্ঠু এবং স্বচ্ছভাবে অনুষ্ঠিত হতে পারে।

অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী সজিব হাসান বলেন, ‘বর্তমান প্রেক্ষাপটে ছাত্র সংসদ শিক্ষার্থীদের অধিকার ও চাহিদার প্রতিনিধিত্ব করার একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। এটি শিক্ষার্থীদের নেতৃত্ব বিকাশে সহায়ক ভূমিকা রাখার পাশাপাশি অ্যাকাডেমিক, প্রশাসনিক এবং সামাজিক সমস্যাগুলোর সমাধানে কার্যকর অবদান রাখবে।’ 

ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে দুই ধরনের মত লক্ষ্য করা গেছে। একপক্ষ দ্রুত নির্বাচন আয়োজনের পক্ষে, তাঁদের দাবি- নির্বাচনের মাধ্যমে ছাত্রদের অধিকার এবং সমস্যা দ্রুত সমাধান করা যাবে। আরেক পক্ষের মতামত, আগে কিছু সংস্কার এবং প্রস্তুতি দরকার, যাতে নির্বাচন সুষ্ঠু এবং স্বচ্ছভাবে অনুষ্ঠিত হতে পারে।

তিনি আরও বলেন, দলীয় লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতির বাইরে থেকে ছাত্র সংসদ শিক্ষার্থীদের মধ্যে একতা ও সংহতি গড়ে তুলবে এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ চর্চার সুযোগ সৃষ্টি করবে। ছাত্র সংসদ কেবল শিক্ষার্থীদের উন্নয়নে নয়, বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক ভাবমূর্তি এবং অগ্রগতিতেও অনন্য ভূমিকা রাখবে। তাই মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এর কার্যকর চর্চা অত্যন্ত জরুরি বলে আমি মনে করি।’

পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষার্থী,  টাঙ্গাইল শহর ছাত্রশিবিরের দপ্তর সম্পাদক এবং ক্যাম্পাসের সাবেক সভাপতি আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘আমি মনে করি, আমাদের ক্যাম্পাসে ছাত্র সংসদ হওয়া দরকার। কারণ ছাত্রদের পক্ষে কাজ করার জন্য ছাত্র দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধি দরকার, যারা ম্যান্ডেট নিয়ে ছাত্র অধিকার রক্ষার জন্য কাজ করবে। তাছাড়া ক্যাম্পাসে বিগত বছরের ছাত্রদের বৈষম্য দূরীকরণের আন্দোলনে দলীয় ছাত্র নেতাদের ভূমিকা ছাত্রবান্ধব ছিলা না।’

তারা মাদক, চাদাবাজি, নিয়োগ বাণিজ্যসহ অপকর্ম করে নিজেদের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করায় ব্যস্ত ছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘তারা ছাত্রদের কোনো অধিকার আদায় তো করতে পারেইনি, বরং ছাত্রদের দমিয়ে রাখতে নানা অপকর্মে লিপ্ত ছিল। তাই আমি এবং আমার সংগঠনের প্রত্যাশা, এ ক্যাম্পাসে ছাত্র সংসদ প্রতিষ্ঠা হোক। ছাত্ররা তাদের প্রতিনিধি বাছাই করুক।’

গণিত বিভাগের শিক্ষার্থী ও ছাত্রদলের নেতা সাইদুল ইসলাম সোহাগ বলেন, ছাত্রদল সবসময় ছাত্র সংসদের পক্ষে। তবে ছাত্র সংসদ চালু হওয়ার আগে কিছু যৌক্তিক সংস্কার প্রয়োজন। যেমন- বিগত স্বৈরাচারী আমলে যারা আওয়ামী লীগের দোসর ছিল কিংবা ছাত্রলীগের সহায়তায় ক্ষমতায় এসেছিল, তারা যেন কোনোভাবেই ছাত্র সংসদের মাধ্যমে পুনর্বাসিত হতে না পারে। এটি নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি।‌’

পাশাপাশি ছাত্র সংসদ নির্বাচনে যারা প্রার্থী হবেন, তাদের বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিগত সময়ে যারা স্বৈরাচার কিংবা ছাত্রলীগের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তারা যেন কোনোভাবেই প্রার্থী হতে না পারেন। এ বিষয়গুলো সুষ্ঠুভাবে নিশ্চিত করা গেলে আমরা যৌক্তিক ছাত্র সংসদ নির্বাচনকে পূর্ণ সমর্থন জানাব এবং সেই নির্বাচনের পাশে থাকব।

ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের শিক্ষার্থী ও টাঙ্গাইল জেলা সমন্বয়ক মো. আক্তারুজ্জামান সাজু বলেন, ‘একবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে জুলাই ২৪ পর্যন্ত দলীয় লেজুড়বৃত্তি ছাড়া যোগ্য ছাত্র নেতৃত্ব তৈরি হয়নি ফলে আমাদের প্রজন্ম নেতৃত্ব শূন্যতায় ভুগছে। ৫ আগস্ট শেখ হসিনাকে উৎখ্যাতের মধ্য দিয়ে তরুণ প্রজন্মের ভেতর নতুন রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে। ছাত্র সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে উঠে আসা ছাত্র নেতারাই পারবে কাঙ্ক্ষিত সোনার বাংলা গড়তে। আমরা শিগগিরই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বরাবর ছাত্র সংসদের নির্বাচনের রোড ম্যাপের দাবি জানাব।’

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের শিক্ষার্থী ও ছাত্রদল নেতা সালাউদ্দিন বলেছেন, ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ একটি নতুন যুগে প্রবেশ করেছে। বর্তমানে দেশে প্রয়োজনীয় সংস্কারের কাজ চলমান, যা জাতিকে সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পথ প্রশস্ত করবে। শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করার পাশাপাশি সংস্কার কার্যক্রম সম্পন্ন হলে, ছাত্র সংসদ নির্বাচন আয়োজন করা যেতে পারে। তবে সংস্কার শেষ না করে এ নির্বাচন আয়োজন করলে তা কাঙ্ক্ষিত ফলাফল বয়ে আনবে না।

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের শিক্ষার্থী তানভীর ইসলাম তামিম বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদের প্রয়োজনীয়তা অনেক এবং এটি একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাংগঠনিক ও শিক্ষামূলক পরিবেশের উন্নতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ছাত্র সংসদ শিক্ষার্থীদের স্বার্থ রক্ষা ও তাদের অধিকার নিশ্চিত করার একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। এটি শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সমস্যা সঠিকভাবে চিহ্নিত করে এবং সেগুলো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে তুলে ধরতে সহায়তা করে। ছাত্র সংসদ শিক্ষার্থীদের নেতৃত্ব ও সংগঠনের দক্ষতা উন্নত করার সুযোগ দেয়।’

এতে অংশগ্রহণকারীরা ভবিষ্যতে সমাজের নেতৃত্বে ভূমিকা পালনের জন্য দক্ষতা অর্জন করতে পারে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ছাত্র সংসদ নির্বাচন ও কার্যক্রম শিক্ষার্থীদের গণতন্ত্র, সমতাভিত্তিক নেতৃত্ব এবং নৈতিকতার শিক্ষা দেয়। এটি তাদের মধ্যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ গড়ে তোলে। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সমস্যা যেমন ক্লাসরুমের সুবিধা, আবাসন সমস্যা, পরীক্ষা পদ্ধতি ইত্যাদি সমাধানের জন্য ছাত্র সংসদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি শিক্ষার্থীদের চাহিদা ও সমস্যাগুলো প্রশাসনের কাছে সঠিকভাবে উপস্থাপন করে এবং উভয়ের মধ্যে কার্যকর যোগাযোগ নিশ্চিত করে।’

আরো পড়ুন: ‘সমন্বয়ক’ পরিচয়ে শিক্ষার্থীকে জিম্মি করে চাঁদা দাবি, আটক ৩

গণিত বিভাগের শিক্ষার্থী তরফদার রোহান বলেন, ‘বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশের পলিটিক্যাল সিস্টেম এতটাই খারাপ হয়ে গেছে, যার দরুন আজকের জেনারেশন এ সম্পর্কে বলে আই হেইট পলিটিক্স। এর একমাত্র কারণ পাওয়ার প্র্যাক্টিস। আমি আজ ক্ষমতায়, তাই আমিই সর্বেসর্বা। আমার অধীনস্হ ও দেশের জনগণ কি চাইল, সেটা মূখ্য নয়, মূখ্য দলীয় রাজনীতি। ঠিক এই ভাইবটাই দেশের প্রত্যেকটা বিশ্ববিদ্যালয় এ চোখে পড়ে। যে দল ক্ষমতায় সেই দলের ছাত্রসংগঠন বিশ্ববিদ্যালয়ের হর্তাকর্তা। নিয়োগ বাণিজ্য, হলের সিট দখল, চাঁদাবাজি, হেডাম নিয়ে চলাফেরা বলতে গেলে অনেক কিছুই।’

এসব দেখেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মন থেকে ছাত্ররাজনীতিতে উঠে গেছে। তাই বিকল্প কি? তিনি বলেন, ছাত্ররাজনীতি থাকবে সেটা, ছাত্র সংসদের মাধ্যমে। বিভিন্ন ক্লাব সংগঠনের মাধ্যমে বুদ্ধিবৃত্তিক রাজনীতি থাকবে। আমার কোন একটা দাবি পার্টিকুলার কোন ক্রিয়াশীল ছাত্র সংগঠন এর কাছে যেতে হবে না। তাদের কাছে ধরনা দিতে হবে না। যে সংসদ এ সমস্ত শিক্ষার্থীদের চাওয়া পাওয়ার প্রতিফলন ঘটবে। এমনকি কোন ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন এককভাবে পাওয়ার প্রাক্টিস করতে পারবে না।’

তিনি আরো বলেন, যারা লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি চান না, তাদের বিকল্প হচ্ছে এই ছাত্র সংসদ। আর জুলাই গণঅভ্যুত্থানের স্পিরিটকে ধরে রাখতে হলে ছাত্র সংসদ আরো জরুরি। ৯ দফার একটি দফা। সেই সাথে ছাত্রসংসদ থাকলে প্রশাসন স্বৈরাচারী মনোভাব দেখাতে পারবে না। শিক্ষক সমিতিও একচেটিয়া প্রশাসনিক বিভিন্ন কাজে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। কিন্ত এত সুবিধা থাকা সত্ত্বেও এর অসুবিধাও আছে। কিন্তু বৃহৎ স্বার্থে এই ছাত্র সংসদ বর্তমানে জরুরি।’

ফার্মেসি বিভাগের শিক্ষার্থী ও ছাত্রদল কর্মী সুমন মিয়া বলেন, ‘ছাত্র সংসদ একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে, ক্যাম্পাসে সুষ্ঠু পরিবেশ এবং প্রয়োজনীয় সংস্কার নিশ্চিত না হলে ছাত্র সংসদ একটি নামমাত্র সংগঠনে পরিণত হতে পারে, যা ছাত্রদের প্রকৃত কল্যাণে কোনো অবদান রাখতে সক্ষম হবে না।’

তিনি বলেন, ‘আমরা সবাই ছাত্র সংসদ নির্বাচনের গুরুত্ব সম্পর্কে অবগত। কিন্তু সুষ্ঠু পরিবেশ ও প্রয়োজনীয় সংস্কার নিশ্চিত না করেই এই মুহূর্তে নির্বাচন দেওয়া কোনোভাবেই যৌক্তিক নয়। প্রথমে শিক্ষার্থীদের জন্য একটি নিরাপদ, স্বচ্ছ, এবং উন্নয়নমুখী পরিবেশ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। তার পরই ছাত্র সংসদ নির্বাচন হওয়া উচিত।’