১০ মার্চ ২০২৫, ১০:৫৭

ইফতার-সেহরিতে থাকে না পুষ্টিকর খাবার, সিন্ডিকেটে কুক্ষিগত শিক্ষার্থীর রমজান

রমজান মাসে শিক্ষার্থীদের অবস্থা নিয়ে কথা বলা চার শিক্ষার্থী

রমজান মাস মুসলমানদের জন্য এক পবিত্র ও আত্মশুদ্ধির সময়। এ সংযমের মাসে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী অতিরিক্ত মুনাফার লোভে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি করে সাধারণ মানুষের জীবনকে কঠিন করে তোলেন। প্রতি বছর রমজানের আগে থেকেই বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে থাকে, যা নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের জন্য বিশাল চাপ সৃষ্টি করে। একইভাবে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা বাড়ি থেকে পাওয়া স্বল্প টাকায় খরচ চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। এ বিষয়ে শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন তাদের ভাবনার কথা । 

বাজার সিন্ডিকেটের কাছে কুক্ষিগত আমাদের রমজান 
রমজানে বিশ্বের অন্যান্য দেশের ব্যবসায়ীরা মুখিয়ে থাকে তুলনামূলক কম মূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য বিক্রির জন্য। কিন্তু বাংলাদেশে দেখা যায় সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র। বর্তমানে বাজারে বিভিন্ন সবজি, খেজুর, ছোলা-বুটসহ প্রায় সকল নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম নাগালের বাইরে। এই বাজার সিন্ডিকেটের সবচেয়ে বাজে প্রভাব আসে আমাদের মতো যারা শহরে থেকে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে হয় তাদের ওপর। 

ক্রয়সীমার বাইরে হওয়ায়, ইফতার ও সেহরিতে প্রয়োজনীয় ও পুষ্টিকর খাবার তো থাকেই না, কোনো রকমভাবে ইফতার-সেহরি করেই দিনাতিপাত করতে হচ্ছে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীদের। বাজার সিন্ডিকেটের কাছে যেন কুক্ষিগত হয়ে পড়েছে আমাদের রমজান। দ্রুত সময়ের ভিতরেই বাজার সিন্ডিকেট রোধ করে নায্য মূল্যে পণ্য বিক্রির ব্যবস্থা করলেই সাধারণ শিক্ষার্থীসহ নিম্ন আয়ের মানুষ স্বস্তির নিশ্বাস নিতে পারবে।

উমায়েতুল ইসলাম প্রান্ত 
ইংরেজি বিভাগ 
সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজে, ঢাকা

স্বপ্ন আজ ক্ষুদার্থ বাস্তবতার কাঁটাতারে আটকে আছে 
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শুধু একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়, এটি স্বপ্নের চৌকাঠ। কিন্তু সেই স্বপ্ন আজ ক্ষুধার্ত বাস্তবতার কাঁটাতারে আটকে আছে। চলমান মূল্যস্ফীতির ছোবলে হাজারো শিক্ষার্থীর জীবন যেন এক নিঃশব্দ দুর্ভিক্ষে পড়েছে। যেখানে মেধা আছে, কিন্তু পেটে ভাত নেই। প্রতিদিন মাত্র ১৮০-২০০ টাকা নিয়ে যুদ্ধ করতে হয় আমাদের। এই টাকায় তিন বেলা তো দূরের কথা, দু’বেলা ঠিকঠাক খাওয়াও এক ধরনের বিলাসিতা। হলের ক্যান্টিনগুলো একসময় স্বল্পমূল্যে খাবার সরবরাহের আশ্রয়স্থল ছিল। কিন্তু এখন সেখানে পরিবেশিত খাবার নিম্নমানের, স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর। 

বাসি ভাত, পানির মতো ডাল আর মাংসের টুকরো যেন দূরবীন দিয়ে খুঁজতে হয়। যার অন্যতম মূল কারণ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। আর এই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি অন্যতম ফল নিম্ন মানের খাদ্য  শুধু পেটেই সীমাবদ্ধ থাকে না, এটি মেধার ক্ষয় ডেকে আনে। পেট খালি থাকলে মনের ভেতর বইয়ের শব্দগুলো কেমন যেন বুদবুদের মতো ভেসে যায়। যে বিশ্ববিদ্যালয় মুক্তচিন্তার জন্ম দিয়েছে, সেই ক্যাম্পাসেই আজ শিক্ষার্থীরা পেটের ক্ষুধায় নিজেদের স্বপ্নকে গিলে ফেলছে। 

এই সংকট আর উপেক্ষার বিষয় নয়। হল ক্যান্টিনের খাবারের মান নিয়মিত পর্যবেক্ষণ, ভর্তুকির ব্যবস্থা ও দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ সহায়তা চালু করা জরুরি। শিক্ষার্থীদের ক্ষুধার্ত রেখে কখনও জাতির ভবিষ্যৎ গড়ে ওঠে না। আমাদের দাবি খুব বেশি নয়, শুধু নায্যমূল্যে বাজারে দ্রব্যমূল্য সরবরাহের মাধ্যমে উন্নত খাবার প্রাপ্তি নিশ্চিত করা। 

মো. শরীফুল ইসলাম 
শিক্ষার্থী মার্কেটিং বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

খাবারের অভাবে শারীরিকভাবে অসুস্থ হচ্ছে শিক্ষার্থীরা 
রমজান মাস এলেই ঢাকার মেস ও হলের শিক্ষার্থীদের জন্য ব্যয় বাড়ার বিষয়টি সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইফতার ও সেহরির জন্য খাবারের দাম স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় বেশি থাকে, যা সীমিত বাজেটের শিক্ষার্থীদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে ওঠে। বাইরে থেকে ইফতার কিনতে গেলে খরচ দ্বিগুণ হয়ে যায়। আবার বাসায় রান্নার সুযোগ থাকলেও বাজারের উচ্চমূল্যের কারণে সেটাও সহজ নয়। এছাড়া অনেকে হলে থাকলেও সেখানে মানসম্মত ইফতার ও সেহরি পাওয়া কঠিন, ফলে বাইরে থেকে খাবার আনতে হয়। 

পরিবহন খরচ, বাড়তি বিদ্যুৎ বিল ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক খরচ যোগ হয়ে মাসের শেষে টানাপোড়েন লেগেই থাকে। অধিকাংশ মেস ও হলের খাবারের মান এমনিতেই ভালো থাকে না, কিন্তু রমজানে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় গুণগতমান আরও কমে যায়। ফলে অনেক শিক্ষার্থী অপুষ্টি বা পেটের সমস্যার শিকার হন। কম খরচে বাইরে থেকে নিম্নমানের ইফতার কিনে খাওয়ার ফলে অনেক শিক্ষার্থী ফুড পয়জনিং বা গ্যাস্ট্রিকের সমস্যায় ভোগেন। 

তাছাড়া, অনিয়মিত খাওয়া ও বিশ্রামের অভাবে শারীরিক দুর্বলতাও দেখা দেয়। এই সব সমস্যার কারণে রমজান মাসে মেস ও হলের শিক্ষার্থীদের জীবনযাত্রা আরও কঠিন হয়ে ওঠে। সরকারের পক্ষ থেকে ন্যায্যমূল্যে খাবারের ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ-পানির সরবরাহ ঠিক রাখা এবং বাজার নিয়ন্ত্রণ করা হলে শিক্ষার্থীরা কিছুটা হলেও স্বস্তি পেতে পারেন।

মো. মিরাজ মিয়া 
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ
সরকারি তিতুমীর কলেজ, ঢাকা

খাবার কেনার খরচ শিক্ষার্থীদের জন্য মানসিক চাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে 
বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে দেশে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি সবচেয়ে বেশি বিপর্যয়ের শিকার হচ্ছেন মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত মানুষজন।খাদ্য, যাতায়াত, বই, পোশাক- এমনকি পড়াশোনার জন্য প্রয়োজনীয় অন্যান্য উপকরণের দামও আকাশ ছোঁয়া হয়ে উঠেছে। ফলস্বরূপ, শিক্ষার্থীরা তাদের দৈনন্দিন জীবনযাপন ও পড়াশোনার পরিকল্পনায় বেশ কিছু বাঁধার সম্মুখীন হচ্ছে। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজে যাতায়াত এবং খাদ্য কেনার খরচ শিক্ষার্থীদের জন্য অন্যতম বড় চাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

অধিকাংশ শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসে পড়াশোনা করতে এসে হোস্টেল বা ভাড়া বাসায় থাকে, যেখানে তাদের প্রতি মাসেই বাড়ির ভাড়া, খাবারের জন্য অতিরিক্ত টাকার বোঝা মাথায় নিয়ে ঘুমাতে হচ্ছে। বিশেষ করে অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা ও দুশ্চিন্তার কারণে অনেক শিক্ষার্থী মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছে, যা তাদের শিক্ষাজীবনে বিরূপ প্রভাব বিস্তার করছে। 

আরো পড়ুন: ছাত্রদল-শিবির-এনসিপির আয়ের উৎস কী, পাল্টাপাল্টি অভিযোগ কেন

সেই সাথে একজন শিক্ষার্থী পুষ্টিগুণ সম্পূর্ণ খাবার খেতে পারছে না। শুধু বেঁচে থাকার জন্য দুবেলা দুমুঠো ডাল, ভাত খেয়ে কোনোরকম দিনাতিপাত করছে। পূর্বের তুলনায় পরিবহন খরচও বেড়েছে, যার ফলে অনেক শিক্ষার্থী বাস বা রিক্সায় চড়ার পরিবর্তে হাঁটতে বাধ্য হচ্ছে। যেটা তাদের সময়ের অপচয় ছাড়াও স্বাস্থ্যগত সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার জন্য বই এবং অন্যান্য শিক্ষা উপকরণের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। তবে এখন বইগুলোর দাম অনেক বেড়ে গেছে। 

অনেক শিক্ষার্থী পুরোনো বই কিনতে বাধ্য হচ্ছে বা ইলেকট্রনিক বইয়ের দিকে ঝুঁকছে। এতে তাদের একদিকে পড়াশোনার মান কিছুটা হ্রাস পাচ্ছে, বাজারে দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় অনেক শিক্ষার্থী পার্ট-টাইম কাজের দিকে ঝুঁকছে। যার ফলে তাদের পড়াশোনা এবং কাজের মধ্যে ভারসাম্য রাখা কঠিন হয়ে পড়ছে। 

দ্রব্যমূল্যর উর্ধ্বগতি রোধে সরকারের উচিত সরবরাহ চেইন উন্নয়ন, ভর্তুকি প্রদান, মজুদদারদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণ এবং কৃষি ও উৎপাদন খাতের উন্নয়ন করা। পাশাপাশি, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রেখে বিদেশি মুদ্রা রিজার্ভ বাড়ানো এবং মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা। সেই সাথে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উচিত, আর্থিকভাবে অসচ্ছল শিক্ষার্থীদের পাশে দাড়ানো অন্যথায় অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা গ্রহনের স্বপ্ন থেকে ঝড়ে পড়বে।

মো. সদর জামিল খন্দকার
ভূমি ব্যবস্থাপনা ও আইন বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়